সোমবার, ১২ নভেম্বর, ২০১২

মাধুবাতা ঋতায়াতে মধুমত পার্থিবং রজহ

আজকে লিখতে বসেছি বটে, কিন্তু মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে কোনো কথা আসছে না লিখে ফেলার মত, লেখার মত হাতে কিছুই নেই, এই দিন টা ছাড়া। শুধু এই দিন টা--এই রোদ ঝলমল করা শীতের সকাল গড়িয়ে বেলা হতে চলা সময় টা--আকাশের একটা দিক জুড়ে রোদেলা বেলায় ওই যে ছোট্ট ছোট্ট মেঘেদের পিকনিক--এই যে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসে ইউনিভার্সিটি র ছাদ থেকে দেখা ছবির মত গোটা ক্যাম্পাস টা, শীতের শুরু তে সবার গায়ে ঝলমলে শীত-পোশাক আর চলনে-বলনে অকারণ হাসির ঝলক ...বেচে থাকা টা হঠাত ই খুব ভালো লেগে যায়, নেশা ধরানো ভালো লাগা ..এই মিঠেকড়া রোদের ওমে কলকাতার শীত কমলালেবু পীঠেপুলি আর মায়ের আদরের জন্যে মন-কেমন চেখে নেওয়া টাও ভারী আরামের লাগে। কলকাতায় এখন আলোয় আলোয় সেজে ওঠা দীপাবলী, এখানেও এগিয়ে আসছে উত্সবের মরসুম, আরো একটা জন্মদিন ও এসে পড়ল বলে, আর ওদিকে বাড়ি যাওয়ার দিন গোনার পালা শুরু হয়ে গেছে--এই সময়ের ভালো লাগা টা ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে এই নরম রোদে, ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে এই শীতার্ত হাওয়ায় ... এই রকম এক একটা সময়ের অপেক্ষাতেই আরো একটা দিন বেচে থাকা যায়, এই রকম এক এক বিন্দু মধুর পূর্ণতার প্রত্যাশাতেই আরো একবার বেচে উঠি অনেক ধূসর মৃত্যুময়তার পার থেকে। 



বৃহস্পতিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১২

বাতাস-বাড়ি

এই যে এখন সাদা চৌকোমত-লাল টালির চাল দেওয়া বাড়িতে আমি থাকি, ঠিকানা বলতেই সড়াত করে বেরিয়ে আসে "ফোর-টু-ওয়ান ..", তা বলে এটা কিন্তু আমার ঠিকানা নয় মোটেই। আমার ঠিকানা রয়ে গেছে সেই ক-বে ছেড়ে আসা দুই-এর-এক ষষ্ঠীতলা রোড এর পুরনো ভাঙ্গা বাড়ি টায়, যেখানে আটকা পড়ে আছে আমার শৈশব। 

কেমন ছিল সেই ঠিকানা আমার? সরু একটা দরজা দিয়ে ঢুকেই মস্ত বড় উঠোন, শাওলার আক্রমনে পিছল--অনেকটা "গল্প হলেও সত্যি" র সেই বাড়িটার মত। উঠোনের চারপাশে একগাদা ঘর, রোজকার হেসেল এর পাশে আবার বাতিল হয়ে যাওয়া উনুন-অলা হেসেল, অন্ধকার কি জানি কিসের আরো কটা ঘর, যেগুলো আমাকে খাওয়ানোর সময় "ভুতের ঘর" হিসেবে কাজে আসত।দোতলার বাইরের দিকে ছিল টানা খোলা বারান্দা, মোটে দোতলা হলেও চারপাশে তখন তো আর বহুতল ছিল না তত; আর পাশে ছিল একটা ছোট কারখানা মত--তাই গরমের সন্ধ্যে সেই বারান্দায় দখিনা হাওয়ার বান ডাকত, বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে জমায়েত বসত গান আর আড্ডার। চৈত্র সংক্রান্তি তে এই কারখানা থেকে আবার যাত্রার আয়োজন হত, আমরা বারান্দায় বসেই দিব্বি দেখে নিতাম সেই যাত্রা--অবশ্য চাঁদ সদাগর এর ওপর রাগ করে মনসা কি বললেন সেটা দেখার আগেই আমি ঘুমে কাদা, কিন্তু ওই যে সন্ধ্যে থেকে ওদের হাজাক লাগানো, একপাশে ত্রিপল টাঙিয়ে মেক-আপ রুম, সেসব একটা আলাদা রোমাঞ্চ নিয়ে আস্ত। মনসার বেগনি রঙের শাড়ী দেখে প্রত্যেক বার ই কেন জানি না, পিসি কে চুপিচুপি একবার আমায় যে শাড়ী টা "বড় হলেই দিয়ে দেবে" বলেছে সেটা সম্মন্ধে নিশ্চিত হয়ে নিতাম।এখন পিসি ও নেই, সেই শাড়ী ও পোকা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু সেই চৈত্র সন্ধ্যার প্রতিশ্রুতি এখনো তার গায়ে মাখানো যে, তাই ফেলে দিতে পারিনি ...

আমি ছোটবেলায় খুব হাদা মেয়ে ছিলুম, (এখনো আছি হয়ত যাকগে জাহির করে কাজ নেই) যে যা বলত সব ই অকুল বিশ্বাসে মেনে নিতুম। আমায় খাওয়ানোর সময় আমি বেগুন ভাজা খাবার বায়না ধরলে আমায় বুঝিয়ে দেওয়া হত যে পাচিলের ওপর সদ্য গজানো আমগাছ টায় বেগুন ফলবে তখন আমাকে নির্ঘাত বেগুন ভাজা করে দেওয়া হবে, তিন সত্যি--আর আমিও অমনি বিশ্বাস করে খেয়ে নিতাম। ওই বাড়িটার দোতলায় ঠাকুমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখতাম একটা সাদা কালো বেড়াল, সে রোজ সূর্য ডোবার সময় এসে বসে থাকত চুপ করে, তাই দেখে একদিন বলেছি যে বেড়াল টা ভক্ত বেড়াল, সূর্য নমস্কার করতে আসে--তা সবার কি হাসি! এই রকম হাজার বোকামি ছড়িয়ে আছে ওই বাড়িটার আনাচে কানাচে, যারা আমাকে একটু একটু করে শিখিয়েছে যে সব কথা ভাগ করে নিতে নেই। কিছু কথা থাকে এক্কেবারে নিজের।

দোতলার সিড়ি বেয়ে উঠতে গেলেই আমার বৈকালিক খেলার জায়গা--আমি আর আমার জ্যাঠতুত দুই বোন অদ্ভূত সব খেলা খেলতাম ওই ধাপটায় বসে--কখনো বাস এর কনডাকটার, কখনো কাজের মাসি, এইসব সেজে খেলা। আর তার ওপরে উঠলে--ছাদ। আমার মুক্তির জায়গা, আমার ছোটবেলার অনেকখানি জুড়ে সে। একপাশের চিলেকোঠায় ঠাকুর-ঘর, তাতে বম্মা সকাল থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে মন্ত্র পরে চলত, আর স্নান সেরে মা পড়তে বসানোর আগে অবধি আমার ছুটি।আপন মনে ঘুরে বেড়ানোর ছুটি, বাধা-বন্ধ-হীন নিজেকে নিজের মত পাওয়া--কখনো আপন মনে কথা কইতাম, নাটকের সব চরিত্র নিজেই হয়ে অভিনয় করে ফেলতাম, সুকুমার রায় এর গল্প গুলো সাজিয়ে বসতাম সেই ছাদ এ। ছাত এর পাচিল ঘেষে একটা অশ্বত্থ চারা হয়েছিল, বাবারা লোক ডাকিয়ে মাঝে মাঝেই কেটে দিত, কিন্তু শিকর টা রয়ে যেত তার, আবার একদিন ইটের কঙ্কাল থেকে উঁকি দিত--আমি উত্সাহ দিতাম এই গাছটাকে খুব, ভাঙ্গা ইটের টুকরো দিয়ে মাপতাম কতখানি বাড়ল গাছটা।তার ডালে একবার বাসা করেছিল কাকে, সেই ছোট্ট ছোট্ট ছানা গুলো লাল লাল মুখ হা করে সারাদিন কি চেচান চেচাত যে, সে এক কান্ড! দুপুর গড়ালে বম্মা বেরোবে পুজো সেরে, আমার বরাদ্দ নকুলদানা নিতে না নিতেই মা এসে পড়বে, আর অমনি আমার ছুটি ফুরিয়ে গিয়ে পড়াশুনোর শুরু ...

পাচ বছর বয়েসেই সেই বাড়িটা ছেড়ে চলে এসেছি, কিন্তু কি সম্মোহন ই না ছিল সেই নোনাধরা পুরনো বাড়িটায়, মনের মধ্যে ছবির মত গেথে আছে দিন গুলো।এখন মস্ত বড়লোক এক মারওয়ারী থাকেন ওই বাড়ি খানায়, সামনে বুগেনভিলিয়ার লতা, বাড়িটা এখন সত্যি ভালো আছে। আমিও ভালো আছি, কার্পেট পাতা বাতানুকুল ঘরের এই বাড়ি টাতে--কিন্তু ওই যে বললাম শিকড়--কে জানে কত গভীরে চারিয়ে গেছে সে, যতবার কেটে ফেলতে চাই আবার সহস্রগুনে ফিরে আসে ...






সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১২

বিদায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

মহানবমীর সুপ্রভাতে কলকাতা যখন জেগে উঠছে আরো একটা সুন্দর পুজোর দিনে, আমার মতন প্রবাসী কিছু মন যখন আকুল আঁখি পেতে জেগে আছে ফেসবুকের পাতায় কলকাতার পুজোর নতুন "updates" পেতে, তখন ই হঠাত এলো খবর টা: চলে গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। হঠাত যেন শেষ হয়ে গেল একটা যুগ--আমার বড় হয়ে ওঠার সেই সময় টা। সেই লেখক, যার কাকাবাবু পড়ে শুরু হত পুজো গুলো, যার প্রথম আলো সেই সময় বারবার পড়েও পুরনো হয়না, যার পূর্ব-পশ্চিম প্রথম চিনিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তমাখা অধ্যায়, যার এক একটা কবিতার পংক্তিতে আটকা থেকেছে আমার কত না গুনগুনিয়ে-ওঠা-ভর--তিনি আর নেই। অপ্রত্যাশিত খবর টায় যেন কি এক ধুসর ম্লানিমা ছিল, মলিন হয়ে গেল পুজো-পুজো গন্ধ টা।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না থাকলে কেমন হত আমার বড় হয়ে ওঠা? প্রথম পড়তে শিখেই সন্তু র সঙ্গে সঙ্গে শিখে নেওয়া হত না কনিষ্ক র ইতিহাস বা হায়রগ্লিফিচ্স এর মানে; ক্লাস নাইন এ বই এর ফাকে রেখে ডুব দেওয়া হত না নীললোহিতের দিক-শূন্যপুরের সন্ধানে; জানা ই হত না অদ্ভূত যে মন-খারাপ গুলো ছেয়ে যেত হঠাত হঠাত, তাদের মানে। এখনো মনে আছে সেই সময় প্রথম পড়ার সেই দিনগুলো--একেবারে বাস্তব-জ্ঞান শুন্য হয়ে সেই কবেকার কলকাতা শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর অনুভব--নবজাগরণের কলকাতা; যা ভারতের ইতিহাসে এতটা তাত্পর্য্য পূর্ণ একটা অধ্যায়, আর কেউ কি এমন করে ধরে রাখতে পেরেছেন কল্পনা-ইতিহাসের মিশেলে এমন সুন্দর করে? সুনীল গান্গুলি র হাত ধরে প্রথম পাড়ি  দেওয়া "আধুনিক কবিতা" নামক ভীতিপ্রদ রাজ্যে--রবীন্দ্র-ছায়া পেরিয়ে অন্য কবিতার গুণগ্রাহী হওয়া টা আমার কাছে বেশ কঠিন ছিল, আছেও--তবে সুনীল এর ঝরঝরে অনায়াস পংক্তি গুলি অর্থ না বুঝেও ভালো লেগে যেত, মন ছুয়ে যেত। তারপর পরলাম পূর্ব-পশ্চিম--আরেক মহা-মূল্যবান রচনা, আমার এপার বাংলার দৃষ্টি তে প্রথম দেখতে পেলাম ওপারের ছবি, প্রথম জানা মুক্তি-যুদ্ধের মানে। এ ছাড়া ভ্রমন-কাহিনী তাই বা এমন সরস এমন সুন্দর করে কে লিখতে পেরেছে, এ দেশে আসার আগে এ দেশ কে অল্প-সল্প চিনলাম ও সেই সব ভ্রমন-কাহিনী পড়েই (অবশ্য সে চেনা বিশেষ কাজে আসেনি, এক ভবঘুরে কবি র দৃষ্টি তে সত্তরের আমেরিকা আর এক ভালোমানুষ ছাত্রীর চোখে আজকের এ দেশ একেবারেই এক রকম নয়)।   
আর ছোট গল্প। সত্যজিত এর পর বাংলা ছোটগল্প আর কারো হাতেই এত সার্থকতা পায়নি। ছোটদের বড় দের সব্বার জন্যে রয়েছে সেই ভান্ডার; নানান স্বাদের নানান বিষয়ের, ধরা পড়ে তার জানার পরিধি আর লেখার বিস্তার, জানান দেয় তার বৈচিত্র।
স্বীকৃতি পেয়েছেন কিছু, অনেক নিন্দা আর বদনাম কুরনোর পাশাপাশি পেয়েছেন অশেষ ভালবাসা ও। পাওনা ছিল আরো অনেক কিছুই, হয়ত বাঙালি বলেই যে সম্মান অধরা থেকে গেল। হয়ত শেষ স্বীকৃতি দিয়ে উঠতে পারবে না কৃপণ বাঙালি। তবু আমার মত আরো অনেকের ই মনে চিরদিনের হয়ে থেকে যাবেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী সুনীল, আর থেকে যাবে আমার কাকাবাবু সমগ্রের পাতায় তার হাতের লেখায় আমার নাম টা। মৃত্যুর কাছে কাকাবাবু হেরে গেলেন বটে, কিন্তু সব হার ই তো শেষ কথা নয় ...


রবিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১২

"আমার রাত পোহালো শারদ-প্রাতে"

আজ মহালয়া। পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের শুভ-সূচনা। আর কয়েক ঘন্টা পরেই আমার চেনা শহর জেগে উঠবে আধ-ভোরের শুভ সুন্দর মুহুর্তে, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত চন্ডিপাঠ আর সুপ্রীতি ঘোষের মধু-কন্ঠে "বাজলো তোমার আলোর বেনু"র সুরে সুরে দুলে উঠবে এক পবিত্র ভোর। এক মুহুর্তে মিথ্যে হয়ে যাবে প্রতি দিনের ক্লেদ-ক্লান্ত জীবন, মূল্য-বৃদ্ধির সঘন ঘনঘটা, এফ-ডি-আই এর সুফল-কুফল সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কচকচি--এক মুহুর্তে আমার শহর সব এক ঘেয়েমি ঝেড়ে ফেলে হয়ে উঠবে সব-পেয়েছির-দেশ। আজ যে মহালয়া, দেবীপক্ষের শুভ-সূচনা। 

বাইরের রৌদ্র-ক্লান্ত অক্টোবর কে পাশে রেখে ক্রমশ হারিয়ে যাই সেই অলীক মহালয়ার ভোরে। চারিদিকের বাস্তব কেমন মিলিয়ে যায় আমার অস্তিত্ব থেকে, স্মৃতির সমুদ্র সেচে খুঁজে পাওয়া মহালয়া র চলে উদযাপন। সদ্য-ঘুম ভাঙ্গা চোখে বারান্দায় দাড়িয়ে সেই পূব-আকাশে একটু একটু করে রঙের ছোয়া লাগার মুহূর্ত টা, চারপাশ থেকে প্রতিদ্বনিত "অহং রুদ্রেভি বসুভিশচরাম্যাহাং", তারপর সাদা ধুতি পরে বাবার সেই তর্পনে যাওয়া আর আমাদের টি ভি খুলে অত্যন্ত হাস্যকর যাত্রা-পালা ধাচের "মহিষাসুরমর্দিনী" দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া -- ফিরে আসে, ঘিরে থাকে। তাই চারিদিকে শরতের বিন্দু মাত্র চিন্হ খুঁজে না পেয়েও মনের আকাশে চলে পেজা তুলো মেঘের আনাগোনা, শিউলি তলা ভরে ওঠে সাদা-কমলার টাটকা আল্পনায়। অনলাইন পূজাবার্ষিকী তে কাকাবাবুর জঘন্য গল্প পরেও সেদিনের সেই হাতে আনন্দমেলা পেয়েই অপ্রকাশিত সত্যজিত আর শৈলেন ঘোষের উপন্যাস গোগ্রাসে পরে ফেলার উত্তেজনা সমান সত্যি থেকে যায়। মনে মনে ফিরে যাই সেই পরীক্ষা-শেষের বিকেলে মায়ের হাত ধরে কুমোরটুলি আর বাগবাজার ঘাটে--সেই তার পরের দু তিন দিনের লাগাতার আয়োজনের শেষে পঞ্চমীতে স্কুলে "আগমনী" অনুষ্ঠানে--সেই চতুর্থীর রাতে ঢাকের বোলে পাড়ার ঠাকুর আসার উত্সাহে, সেই বাড়ির সামনে এক গুচ্ছ টুনির আলোয় এক বছরের অপেক্ষার শেষে হঠাত এসে পড়া দুর্গাপুজোর আনন্দে। জানি না কবে আবার কলকাতার দূর্গা পুজো মেখে নিতে পারব সারা গায়ে, কবে আবার ফিরবে সেই বোনের সঙ্গে উত্তর-মধ্য কলকাতা চষে বেড়ানো আর পেটপুরে ফুচকা-ঘুগনি-আইসক্রীম এর দুপুর--হয়ত ফেরার দিন যখন আসবে অনেক অনেক পাল্টে যাবে জীবনের রং, অনেক বদলে যাবে সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা--শুধু জানি সেদিন ও বাগবাজার মন্ডপে দেখা পাব চিরন্তনী সেই মাতৃ-মূর্তির, সেদিন ও মহালয়ার ভোরে ঘুম ভাঙ্গাবে "রূপং দেহি জয়ং দেহি যশ দেহি"র চিরন্তন প্রার্থনা। 

বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

গল্পের মত ..ঈশ্কুল্ বাড়ি টা ...

অনেক দিন লিখি করেও এই লেখাটা লেখা হয়ে ওঠেনি, দু-এক পংক্তির পর ই পছন্দ হতে চায়না, মুছে দিতে হয়। আজ আবার বসেছি মনের মধ্যে একঝাঁক কথা নিয়ে, আমার স্কুল কে দেব বলে--আমার স্কুল এর ছবি আঁকব বলে ...
রূপকথা সবাই পড়ি বটে, কিন্তু সবার জীবনে রূপকথা আসে না; হয়ত এলেও তখন খেয়াল করে চিনে নেওয়া যায় না তাকে, এতটাই বাস্তব হয়ে থাকে সে জীবনে জড়িয়ে। আমার, আমাদের স্কুলবেলা তা ছিল এমনি এক রূপকথার অংশ--তখন সে এমন করেই জড়িয়ে ছিল অস্তিত্বে, তাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে ই নিতে শিখেছিলাম, কখনো তার বিশেষত্ব টের ই পাইনি। তারপর সেই ঠাকুর-দালান, সেই সিং-দরজা, সেই নিকোনো উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে এলাম যেদিন, বাইরের দুনিয়াটার পানে চেয়ে বুঝলাম, অজান্তেই কি স্বপ্নিল একটা ছোটবেলা পেয়েছি স্কুল এর কাছে। সেদিন থেকেই স্কুল মানে এক তীব্র nostalgia, এক অদ্ভূত মন-কেমন, এক অন্যরকমের প্রাপ্তি ...

ছোট্ট সেই এক চিলতে স্কুল, পুরনো কলকাতার গন্ধ মেখে গলির মধ্যে অন্তরীণ--না আছে খেলার মাঠ, না আছে বাইরের দুনিয়ার কাছে বুক ফুলিয়ে দাড়াবার কৌলিন্য--কিন্তু শতাব্দী-প্রাচীন সেই বাড়িটাতে কি যে আশ্চর্য সম্মোহন, অচেনা মন-খারাপের বিকেল গুলোয় আজ ও ডাক দেয় সেই ঠাকুর-দালান, সেই ক্রিস্টিন বাড়ির বাগান। সে স্কুল যেন কোনো বাস্তব পৃথিবীর জমিতে দাড়িয়ে নেই, তার আনাচে কানাচে জমে থাকা সাম গানের সুর, তার প্রতিটি দিনের মধ্যে মিশে থাকা শিক্ষয়িত্রী দের সস্নেহ শাসন--সে এক অলীক জগত। হাজার নিয়ম-অনুশাসন ছিল, ছিল হাজার বকুনি-শাস্তি র ভয়, পড়া না পারার দুকখ, সারাদিনের পর ক্লান্ত শরীরে ভারী bag এর বোঝা--কিন্তু তার ই মধ্যে কখন যেন মনের মধ্যে একটু একটু করে ঢুকে পরেছে গোটা স্কুল টা। এখন যখন ছুটির দিনে দেখা করতে যাই, চুপ করে বসি ঠাকুর-দালান কিম্বা ভিতরের ঠান্ডা লাল মেঝের বারান্দায়, মনের পর্দায় ঢেউ তুলে যায় কত না দৃশ্য : ওই তো আমি লাল-পাড় সাদা শাড়ী পরে বারান্দায় বসে অনুষ্ঠানের রিহার্সাল এ; কবিতার একটা পংক্তি কিছুতেই প্রভাতিদির মনমত হচ্ছে না--ওই তো আমি ক্রিস্টিন বাড়ির পথে কাক-ভেজা হয়ে চলেছি ছাতা হাতে দোলাতে দোলাতে; এই বুঝি কাকলি দি দেখতে পেয়ে গম্ভীর এক ধমক দেবেন--ওই তো আমরা কজন map-ঘরের মধ্যে; মানসীদি জুড়ে দিয়েছেন আমাজনের জঙ্গল নিয়ে ভৌগলিক গল্প--ওই তো ছুটির পর শতাক্ষীর সঙ্গে উত্তেজিত আলোচনা হাজার চুরাশির মা নিয়ে; নতুন সব ভাবনার স্রোত দানা বাধতে না বাধতেই আলোচনা কে নরম করে দায় বুঝি শঙ্খ ঘোষের পদ্য--ওই তো সেই মন্দিরের মত চুড়ো টা; স্বাধীনতার দিনে তেরঙ্গা পতাকাটা যার মাথা ছাড়িয়ে স-ও-ও-জা উঠে যায়--আমার চারিদিকে ঘিরে দাড়ায় সেই খেয়াল-খুশির-ক্লাস, সেই পনেরই আগস্ট এর চার্ট বানানো উত্সব, সেই তিনতলার ছাত থেকে দেখা এলোমেলো গঙ্গা ...
স্কুল আমার প্রথম বন্ধন, প্রথম স্বাধীনতা ও; স্কুল আমার কাছে প্রথম সেখা অনেক কিছু, যেগুলো মাঝে মাঝে ভুলে যাই বলেই আজ এত খারাপ থাকি; স্কুল আমার কাছে একদম আমার, একদম নিজস্ব একটা জায়গা, যেটা আমার সব থেকে অন্ধকার সময়েও আমার জন্যে প্রার্থনার প্রদীপ জ্বেলে রাখবে, আমার সব থেকে একলার দিনেও আমায় আপন করে নেবে...আমার সব-টুকু কিশোর-বেলা গচ্ছিত রেখেছি যে তার কাছে... 

রবিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

খাপছাড়া

আরো একটা অকাজের দিনের পর রাত এসেছিল নিয়ম করেই। কিছু কাজ কিছু অকাজ সেরে আমি অনেক দিনের ই মত বসেছিলাম একটা প্রিয় সিনেমা নিয়ে : Harry Potter এর তৃতীয় গল্পটা ... প্রতিটি দৃশ্য জুড়ে লেগে থাকা আমার সেই কিশোর -বেলা, প্রতিটি প্রায়-মুখস্থ সংলাপ-এ সেই হারানো আবেগ অনুভব করছিলাম প্রান-ভরে--এই অবধি সব ঠিকঠাক ই ছিল; একটা সাধারণ দিনের একটা সাধারণ কিন্তু সুন্দর সমাপ্তি--কিন্তু বাদ সাধলো জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে যাওয়া ওই চাঁদ। আজকের দিন তার ই মত সাধারণ, নিপাট মধ্যবিত্ত চাঁদ--কিন্তু খড়খড়ির পাখির ফাঁক দিয়ে হঠাত তাকে দেখেই ভীষণ মন কেমন করে উঠলো; আলো নিভিয়ে জানলার খড়খড়ি খুলে গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়--রাস্তার মরা পথ-বাতির আলোর সঙ্গে মিশে সেই এক-চিলতে চাঁদের আলো ভরে দিতে লাগলো আমার ঘর। এই বাতানুকুলতার বাধা পেরিয়ে এক-আকাশ রাত উপচে পড়ল আমার আনমনা বিছানায় ... মনে গুনগুন করে ভেসে এলো সেই চেনা মন-কেমন। 
নতুন কোনো অনুভূতি নয়। আর সব ভাবনার মত এটাও রবি-ঠাকুর শতাব্দী আগেই ছন্দে গেথে রেখে গেছেন--"হেথাও ওঠে চাঁদ আকাশ-পারে / পরশ মাগে আলো ঘরের দ্বারে / আমারে খুজিতে সে ফিরিছে দেশে দেশে / যেন সে ভালোবেসে চাহে আমারে".. তবু , জানা জিনিস নতুন করে জানার ই কি কম মজা? পড়া পংক্তি নতুন করে আবিষ্কার করে তাই চুপ করে শুয়ে থাকি--আর আরো একবার হতাশ বিস্ময়ে চেয়ে দেখি "যত দুরে দুরে যাবে বন্ধু", সেই চেনা শহর চেনা মুহূর্ত চেনা পিছুটান এর নাগাল ছাড়িয়ে যাওয়া আর হলো না--আর নিজের মধ্যবিত্ত মনের দিকে তাকিয়ে দেখি এই বারে বারে ফিরে আসা স্মরণ, এই ভীষণ পুরনো একঘেয়ে মন-কেমন--এগুলো ছাড়া আমি আমি নই। তাই এই অতীতের মালা ছিড়ে ছড়িয়ে পড়া মুহুর্তের অঞ্জলি ই দিলাম তোমায়, ভিনদেশী চাঁদ। পূর্নিমার সার্থকতা না থাক তোমাতে, নাই থাক শারদ-শশীর স্মিত সৌন্দর্যের ডালি, আমার সাধারনত্বের রাজ্যে তুমি চির-স্বাগত।

সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২

একটি আষাঢ় এর দিনলিপি

কলকাতায় এখন বর্ষা । আমার অস্টিনের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে আমি কলকাতার মেঘ দেখতে পাই, বাইরের খটখটে রোদের পাশে কান পাতলে  শুনতে পাই  অঝর ধারায় ঝরে চলা শ্রাবণ কে। বাইরে নিরানন্দ দারুন গ্রীষ্ম, কিন্তু মনে আমার বর্ষার ঢল নেমেছে।
আজকের এই আগতপ্রায় সন্ধের অবসরে যদিও আমার মন জুড়ে দিল্লির বর্ষা। সে শহরে বর্ষা এক বিরল উচ্ছাস, একবার ই মাত্র দেখা পেয়েছিলাম তার, আর সেই একটি বর্ষাই আমার জীবন বদলে দিয়েছে।
তখন কলকাতা থেকে সদ্য এসে পরেছি রাজধানীর বুকে--নতুনত্বের উত্তেজনা, ইতিহাস-ঋদ্ধ প্রাচীন শহরের সান্নিধ্য সব মিলে ঝড় তুলেছে ইন্দ্রিয়-জগতে -- এমন  সময়  বন্ধুর মত আকাশে এসে হাজির হলো কলকাতার সেই চেনা বর্ষা ই।   সেই কালো ঘনঘটা, সেই সারাদিন ঝিরঝির ঝমঝম। আমার ঘরের পিছনের badminton কোর্ট থেকে সন্ধে হলেই ভেসে আসতো সোদা মাটির বাস আর ঝি-ঝি পোকা দের ঝিল্লি। হঠাত করে আকাশে খেলে যাওয়া সেই "নব জলধরে বিজুরী-রেখা", একা-ঘরে প্রথম বার সেই বাজের ভয়-দেখানো গর্জন শোনা, আর সবকিছুর মধ্যে মাখানো যেন এক নতুন দেশে আমায় নিয়ে যাবার স্বপ্ন--হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনখানে। সে বর্ষা যেন এক না-জানা মন কেমনের, না চেনা অতিথির জন্যে আকুল, সে বর্ষা যেন না-চেনা রঙের গভীরে ডুবে যাবার ইশারা, সে বর্ষা যেন গভীরতার নীলে  অবগাহনের আবাহন ...

আমার মনের কোন এক কোণে  এখনো জমে আছে সেই প্রতিটি সন্ধে, সেই ভিজে সিড়িতে চায়ের আড্ডা, সেই বর্ষণ-সিক্ত রাতে দোলনা, সেই আপন-মনে উঠোনে বন্ধুদের সঙ্গে ভেজা ..আর মন-কেমন, এক সমুদ্র মন-কেমন ...প্রতিটি বিন্দু তে যেন ধরা আছে সেদিনের সেই নিজেকে নতুন কে চেনা, একটু একটু করে পাল্টে যাবার, একটু একটু করে ইচ্ছেগুলোর নতুন রং ধরার ইতিহাস।

সেই বর্ষা এসেছিল যেমন আচমকা, চলেও গেছে হঠাত ই। শুধু বদলে দিয়ে গেছে আমায়। বদলে দিয়ে গেছে মেঘের দিকে তাকিয়ে ভেবে চলা আমার অলস ভাবনা গুলো, বদলে দিয়ে গেছে আমার মন-কেমনের রং। পরের বছর বর্ষা আর আসেনি দিল্লি তে, দিল্লির বর্ষা আমার আর দেখা হয়নি। কিন্তু সেই এক বর্ষাকাল ই দিয়ে গেছে জীবন-জোড়া স্মৃতি, যা এই বর্ষা-হীন অস্টিনের বুকেও ফুরোয় না ....

রবিবার, ৫ আগস্ট, ২০১২

বিকেলে ভোরের ফুল

এক একটা দিন হঠাত বলা নেই কওয়া নেই এমন করে ফিরে আসে...তার অনুভব-গন্ধ-রং, সব টুকু নিয়ে...অনেক দিনের হারা গানের মত ঘুরে বেড়ায় কোন বাতাসে...তার দাবি না পারি উপেক্ষা করতে, না পারি বর্তমানের ভিড়ে তাকে জায়গা করে দিতে, তাই গেথে রাখি দিনলিপির পাতায়....
তেমন করেই হঠাত আজ ফিরে এসেছে একটা বিকেল-- ২০০৩ এর ১২ ই মার্চ এর বিকেল...দিন তার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে ওই দিন টায় আমার মাধ্যমিক শেষ হয়েছিল | বছর তিনেক ধরে "জীবনের সবচেয়ে প্রথম আর সবচেয়ে বড় " পরীক্ষা র অপেক্ষা শেষ..শেষ ইস্কুল এর গন্ডি তে বাধা নিরাপদ আশ্রয়ের জীবন | সেন্ট মার্গারেট স্কুল বাড়িটা থেকে বেরোতেই বিকেলের একরাশ হওয়া ঝাপিয়ে পড়ল চোখে মুখে...দিশেহারা লাগছিল--এত টা ছুটি নিয়ে আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না...এক হাতে বন্ধুর পড়তে দেওয়া Harry Potter এর চতুর্থ বই ; প্রথম তিন টে শেষ হার পর যেটা সে আমায় কিছুতেই তার আগে দেয় নি; পরীক্ষার  পড়ার  ক্ষতি হবে আশঙ্কায়; বাড়ি গিয়েই   পড়ে  ফেলতে হবে |ওদিকে অপেক্ষা করে আছে দুদিন পর দীঘা আর এক সপ্তা পর সিমলা-মানালি র হাতছানি; অপেক্ষা করে আছে সদ্য সেমিফিনাল জিতে ওঠা আর সচিন এর  দুর্দান্ত ফর্ম সমেত ইন্ডিয়া...অপেক্ষা করে আছে হালকা  হাওয়ার   কয়েকটা মাস, যখন কিছুটি ভাবতে হবে না...আর তার ও পরে কি যে অপেক্ষা করে আছে তাকে তখন চেনাই হয়ে ওঠেনি...
মায়ের হাত ধরে টুকরো কিছু কেনাকাটির হাতিবাগান, হঠাত ই ঝেপে বৃষ্টি এলো...ছাউনির তলায় দাড়িয়েও ভিজে একসা আমি আর মা...আর সেই চুল বেয়ে চুইয়ে নামা জলের গন্ধ নিতেই নিতেই হঠাত করে বড় হয়ে যাবার অনুভূতি টা ছেয়ে গেল আমার সত্তায়...
এখন কেন ফিরে এলে তুমি, সেই সোদা বাস, সেই ছুটির হাওয়া, সেই আনন্দ-কান্না-ভয় সব মিশে এক হয়ে যাওয়া বৃষ্টি? আজকে যে তোমায় বড় অলীক বড় অপার্থিব মনে হয়, সেদিনের সেই বেণী দোলানো শারী পরা কিশোরীর মধ্যে খুঁজে নিতে কষ্ট হয় এই আমাকে...আজকে যে বড় বিবর্ণ বেচে থাকার এই সময়ে কিছুই রাঙানো হলো না...আজকে তোমার সেই সরল, উজ্জল, তীব্র ভালো থাকার পানে চাইতে ভয় করে, হিংসে হয় আমার...তোমার সেই নতুনের ডাকে উদ্বেল সময় প্রশ্ন করে আজকের এই ক্ষত-বিক্ষত পুরনো আমি টাকে--চাওয়া পাওয়া র হিসেব দেখতে চায়..কি দিয়ে ভরাই আমার পরবর্তী এক যুগের হাজার হারের শুন্যতা? তার চেয়ে  থাক না-- এই ধূসরতায় বাস করতে করতে ভুলে যাই রং কে, ভুলে যাই সেই মার হাত ধরে ভিজে শারী পরে দাড়িয়ে থাকা কিশোরী কে...

 

মঙ্গলবার, ২৬ জুন, ২০১২

রূপকথারা...

ছোট্টবেলায় পড়েছিলাম রূপকথা : কোন দেশে কোন দুষ্টু জাদুকর বানিয়েছিল এক জাদু-আয়না, যার ভিতর দিয়ে দেখলে সব সুন্দর অসুন্দর হয়ে দেখা দেবে; যা কিছু শুভ তার ভিতর থেকে উঁকি দেবে অমঙ্গলের ছায়া; পৃথিবীর রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ ভরা শোভা হয়ে উঠবে যেন এক নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ-চিত্র...সেই আয়না কিকরে যেন গেল ভেঙ্গে, তার টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ল হাওয়ায় হাওয়ায়, তার ই দুটি খন্ড এসে পড়ল মস্ত শহরের বাসিন্দা এক ছোট্ট ছেলে Kay এর চোখে আর হৃদয়ে, তাকে ভুলিয়ে দিল ঠাকুমার মুখে শোনা রুপকথাগুলো, ভুলিয়ে দিল তার খেলার সাথী Gerda কে, আর কি এক মোহময় আকর্ষণে তুষার-রানী টেনে নিল তার তুষার-শীতল হয়ে যাওয়া ছোট্ট মন টিকে...
তারপর সে কেমন করে পৌছালো তুষার-রানীর প্রাসাদে, কেমন করে Gerda অপরাজেয় ভালবাসায় খুঁজে পেল তাকে আর চোখের জলে গলিয়ে দিল তার বুকে বিধে থাকা আরশির টুকরো--সে অন্য গল্প | ভারী ভয় করত ছোটবেলায় এই গল্প তা পড়তে পড়তে-- চেনা পৃথিবী কে অচেনা চোখে দেখার ভয়; চেনা মানুষ কে চকিতে বিস্মরণের ভয়...
আজ ও ভয় পাচ্ছি--বড় হতে হতে কখন হয়ত বেখেয়ালে আমার চোখে বিধে গেছে সেই ভাঙ্গা আরশির অবশেষ--নইলে কেন এই সবুজ সুন্দর পৃথিবী টাকে এত ধুসর দেখছি প্রতিদিন; কেন সকালের সোনার সূর্য ঠিক তেমন করে আলোয় আলো করে তুলছে না আমার দিনগুলো; কেন চেনা-না-চেনার দ্বন্দ নিয়ে তাকাই আজ  মানুষের দিকে--খুঁজে পাই না বিশ্বাসের ভিত? সেই সকাল গুলো, যখন অবন ঠাকুরের "কুকড়" সকাল কে আবাহন করে অন্ত "আলোর ফুলকি" গান দিয়ে--সেই মন-খারাপ-করা মেঘলা বিকেল গুলো যখন আকাশের দিকে চাইলেই চোখে পরত মেঘবরণ কন্যে তার কুচবরণ কেশ--সেই পৃথিবী কে প্রথম দেখার রঙিন বিস্ময়--আজ কেন এত অলীক এত বেমানান বোধ হয়? কেন এত বড় হয়ে গেলাম যে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না বুকে কাটা বিধিয়ে সারারাত গানে গানে রক্ত-গোলাপ ফুটিয়ে চলা nightingale এর গল্পটা, বোকা মনে হয় অচেনা ভালবাসার টানে নিজের জগত ছেড়ে চলে আসা mermaid কে, গাজাখুরি মনে হয় তিনবার হাতে তালি দিয়েই অঘটন-ঘটন-পটিয়সী জাদুকরী ভাসিলিসা র কাহিনী--কেন, কেন? কখন যেন এই দুনিয়া আমার চোখে আমার বুকে বিধিয়ে দিয়েছে সেই জাদু-আয়নার টুকরো; তাই সাদা আর চোখেই পরে না, তির্যক এক পৃথিবী কে অবিশ্বাস আর ভয়ে দেখে যাই আমি, আর অপেক্ষা করি যদি কোনো দিন ও কোনো উষ্ণ অশ্রুর বাধ ভাঙ্গে আমার মনে, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মত জেগে ওঠে ঘুমিয়ে থাকা উষ্ণতা, নব-আমন্ত্রণে জড়িয়ে ধরি হারিয়ে পাওয়া আমার সুন্দর জগত টাকে...তুষার-রানীর এই প্রাসাদে সে দিনের আর যে কত দেরী...

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

ম্যায় পল দো পল কা শাযর হু

মুহূর্ত মুহূর্ত নিয়ে আমার বেচে থাকা; মুহুর্তের পর মুহুর্তের মালা গেথে সঞ্চয় আমার স্মৃতি..আর কত তুচ্ছ ঘটনায়,কত তুচ্ছ জিনিসেই না ধরা থাকে সে মুহুর্তের সঞ্চয়...কখনো আকাশ ঝাপিয়ে ঝরতে থাকা বাদল এ ধরা থাকে আমার শৈশব, মনে পড়ে যায় কোনো শ্রাবনী বিকেলে উথাল-পাথাল গঙ্গা আর দক্ষিনেশ্বর- বেলুড় খেয়ার নৌকোয় মার সেই ভয়-পাওয়া মুখ--কখনো এমনকি ছবিতেও কৃষ্ণচূড়া র লাল দেখলেই এই দূর প্রবাসে ফিরে আসে আমার বাড়ির সেই নিভৃত ঘরটি,পাশে সেই কৃষ্ণচুড়ার গাছ--কখনো কোনো গান এ হঠাত খুঁজে পাই অটো চড়ে সেই কলেজ যাওয়ার পথটা--কখনো পুরনো স্কুল এর খাতার পিছনের পাতায় আঁকা-বাঁকা হাতের লেখায় ধরা থাকে অমলিন বন্ধুত্বের স্পর্শ...মুহূর্ত-মুহুর্তের মধু জমিয়ে ভরে তুলি জীবনের ছোট্ট কুঠরি..

তাই যখন ফেলে আসা মুহূর্ত গুলো অবিরাম পিছু ডাকে বারবার থামিয়ে দেয় আমার চলা, যখন ছুটে চলতে চাই কিছু নতুন মুহূর্ত কে ছোব বলে, প্রশ্ন করি নিজেকেই : এই যে এই মুহূর্ত গুলো ; কখনো যাদের ঘৃণায় দুরে ঠেলে দিছি বা কখনো মুঠি ভরে ধরে রাখতে চাইছি কিন্তু কখন যেন মুঠি গলে চলে যাচ্ছে--এরাও কি কখনো এমন করে মনে পড়বে? এই যে একলা ঘর এই যে নিত্যদিনের গতে ব্নাধা জীবন এরাও কি কখনো ভাবাবে?ক্নাদাবে? এখনকার ছোট সুখ ছোট দুক্ষ ও কি কোনদিন এমন করে পথ আগলে দাড়াবে অনিবার্য পিছুডাক হয়ে?
প্রশ্ন ফিরে আসে নিজের কাছে...সময়ের নাম লেখা মুহূর্ত ফেরে না...


সোমবার, ১১ জুন, ২০১২

যখন জমে ছিল কাজের পাহাড়, তখন ফাকি দিয়েও এসে বসতাম তোমার পাশে; হোক না সে একটু ক্ষণের জন্যে...আর আজ, যখন একরাশ আলগা সময় ঘিরে আছে আমায়, কাজের চাপ নেই দম বন্ধ করে; এখন ই আমার দেখা করার সময় হয় না তোমার সঙ্গে...আমার অলস সময় নিয়ে এখন ই যেন ভারী ব্যস্ত আমি...
জানি তুমি রাগ করেছ...তাইত গত দুদিন তোমার বাড়ি অবধি গিয়ে কড়া ও নেড়েছিলাম তোমার দরজায়--তুমি খোলনি দুয়ার..সেদিন রাতে অনেক ভেবেছি তোমার কথা, কিন্তু কল্পনায় তোমার মুখ ও ঝাপসা হয়ে গেছে,অভিমানের কুয়াশা পেরিয়ে খুঁজে পাইনি তোমায়...
কি করি কি করি আমি, ভাবনা অজস্র ভাবনায় ভরা যে আমার অবসর--কখনো এমন ভাবনা যাদের দিনের আলোয় এনে দেখতে ভয় পাই; কখনো এমন আলগা ভাবনার স্রোত যারা একের পর এক ঢেউ দিয়ে আবার মিশে যায় অতলান্ত সাগরে, খুঁজে পেতে মালা গেথে নেব এমন ফুরসত ই বা দেয় কই--কি করি কি করি-- আমার এ অলস সময় যে আমাকে বেধে রেখেছে কঠিন নিগড়ে;তার হাত ছাড়িয়ে তোমার কাছে পৌছই এমন সাধ্য কই আমার...
তাই হোক তাহলে, মুখ ফিরিয়ে থেক অভিমানে, ডাকলেও দিও না সাড়া..আমি বসে থাকি অপেক্ষায়--কবে আসবে প্লাবন, আমার দুকুল ছাপিয়ে জেগে উঠবে ভালো-লাগা, আকাশ ধরা দেবে আমার দু-বাহুর শৃঙ্খলে..সেদিন সেই সুর্যোদয়ের ক্ষণে বুঝি তুমি ফিরবে আমার কাছে, অসত্য হতে আমায় চিরসত্যে নিয়ে যাবে বলে..অন্ধকার হতে আমায় আলোয় নিয়ে যাবে বলে..মৃত্যু হতে আমায় অমৃতে পৌছে দেবে বলে?


শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

"আমার ছুটি নীল আকাশে.."

ছোটবেলায় সবার ই বোধয় একটা খুব প্রিয় শব্দ থাকে "ছুটি"| ক্লাসরুম এ একঘেয়ে পড়াশুনোর ফাকে তৃষিত মন তা বসে থাকত কখন বৃন্দাবন-দার ঘন্টা বেয়ে ছুটি ঝরে পড়বে দিনের বুকে--পুজোর আগে আগে হাফ-য়িয়ারলি এসে যাবার সময় থেকেই চলত পুরোদমে পুজোর ছুটির দিন গোনা, আর রোদের তাপ বাড়তে বাড়তে যখন ই বাড়ি ফিরে ডাবের জল না পেলে চলত না, তখন  ই এসে  যেত গরমের ছুটির সময় | ছোটবেলা টা ছুটি ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকত | ছুটি মানেই সেই বেলা করে ওঠা, পড়তে বসার কোনো তাড়া ই নেই, অলস একগুচ্ছ দিন ধীর লয়ে কাটিয়ে দেওয়া...ছুটি মানেই দুপুর বেলাটার জন্যে অপেক্ষা করে থাকা কখন "ছুটি-ছুটি" শুরু হবে--সেই মিনিট দশ মাজিক মিনিট দশ গান-গল্প আর তারপর কিছুটা সিনেমা | প্রথম "জয় বাবা ফেলুনাথ" ছুটি-ছুটি তেই দেখি, মনে আছে..তখন সিনেমা জিনিস তাও এমন চট করে লাপটপ খুলেই দেখে নেওয়া যেত না, তাই সেটাও একটা আকর্ষণ ছিল বৈকি | আর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে গ্রীষ্মের দুপুরে পর্দা-টানা আলো-আধার ঘর, খাতে উপুড় হয়ে শুয়ে কোনো গল্পের বই এর মধ্যে ডুব দিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া...আমি বরাবর ই একটু ঘরকুনো, তাই ছুটির সব-সেরা আনন্দ ছিল এই বই নিয়ে সারাদিন এর সফরেই...এখনো শ্রেষ্ঠ সময় কাটানো বললেই স্বর্গের মত সেই আবছায়া ঘর, মাঝে মাঝে মায়ের দিয়ে যাওয়া আমের সরবত এ চুমুক আর "hunchback of notre-dam" এর পৃষ্ঠা গুলোই মনে পড়ে...অবশ্য এই অলস মধ্যাহ্ন গুলোর দাম করায়-গন্ডায় চুকিয়ে দিতে হত স্কুল খোলার আগে আগে অজস্র ছুটির কাজের চাপ সামলাতে সামলাতে--সে তখন দু তিন দিনের মধ্যে ২০ পাতা হাতের লেখা, ৫ দিনের দিনলিপি আর শ-দুএক অঙ্ক নামানোর ঝক্কি! তবু, সব মিলিয়েও সে দুপুরগুলো র জন্যে এটুকু ঝামেলা নেওয়া ই যায়, তাইনা?
তখন ঠাকুমার ছিল অসুখ, তাই ছুটি মানে খুব বড় বড় বেড়াতে যাওয়া হয়ে উঠত না, হয়ত মাঝে মাঝে পুরি, কি দীঘা, কি বীরভুম, এইরকম...মাধ্যমিকের পরে ছুটি তে যোগ হলো সেই মাত্রা টাও; ছুটি আসার অনেক আগে থেকে সেই রবি ঠাকুরের কবিতাটার মতন ই কথায় যাওয়া যায় এর plan শুরু হয়ে যেত, তারপর ছুটি পড়তে না পড়তে শুরু গোছগাছ, উদ্যোগ-আয়োজন...তখন ছুটি মানে প্রথম ভাগে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ, গোছগাছ প্রস্তুতি, আর দ্বিতীয় ভাগে বেড়িয়ে ফিরে আসার পরের ক্লান্তি, মন-খারাপ,বেড়ানোর আড্ডায় মশগুল কিছু সন্ধ্যেবেলা...সেই ছুটি গুলো কোনটা সিমলা-মানালি, কোনটা ভাইজাগ-আরাকু, কোনটা শ্রীনগর-পাহেল্গাম বা গান্গ্তক-পেলিং বলেই চিন্হিত হয়ে আছে; কোনো ছুটির কথা মনে পড়লেই মন-জোড়া পেলিং এর মেঘলা সকাল আর কুয়াশা মাখা ছান্গু, কোনো ছুটির গায়ে এখনো লেগে আছে ডাল লেকের জলের ছিটে--আর সঙ্গে সেই একটু-একটু করে বড় হবার আধ-চেনা অনুভূতি...
ছুটির মানে বদলে গেল দিল্লি যাওয়ার পর; সঙ্গে বদলালো সময় টাও! এই প্রথম দেখি পুজোর ছুটি উধাও হয়ে গেল, বদলে এলো মাস-জোড়া শীতের ছুটি! আমি অবশ্য কোনো দিকেই আপোষ এর পাত্রী নই, শীতের ছুটি টা যেমন খুশি হয়েই নিয়েছিলাম হাত পেতে, তেমনি পুজোর সময় ও এক সপ্তার অঘোষিত ছুটি করে নিতে আমার অসুবিধে হত না | গোল্লায় যাক পড়াশুনো-ক্লাস; কলকাতায় যখন মন্ডপে মন্ডপে ঢাকের তালে দেবী-বরণ, আমি তখন বই এর পাতায় মুখ গুঁজে থাকব?--কাভি নেহি! সুতরাং এক নম্বর: পুজোর ছুটি, এক সপ্তার; মানেই বাড়ি যাওয়া আর গত সপ্তা শহর জুড়ে টহল...দু- নম্বর, নতুন পাওয়া শীতের ছুটি, যার মানে হলো সেমেস্টার শেষ করে আবার রাজধানী,কলকাতার নরম শীতের রোদ্দুরে কমলালেবু আর চুল-শুকনোর নাম করে ছাদে পাড়া-পর্যবেক্ষণ আর পিকনিক আর ক্রিসমাস এর নাহুম! তবে সবচেয়ে বড় ছুটি টার পুরোটা আর ছুটি করে পাওয়া হয়ে ওঠেনি, একভাগ চলেই গেছিল বিচ্ছিরি ইংরেজি শব্দে র সাধনায় (সাধে বলে,"শব্দ-ব্রহ্ম"!) বাকিটুকু নিয়ে অবশ্য সেই ছোটবেলার মত অলস দিন...
বিদেশে এসে দেখি ছুটি অনেক এবং অনেক প্রকার ও বটে..সপ্তায় সপ্তায় এরা সপ্তাহ শেষ হবার আনন্দেই ছুটি উদযাপন করে থাকে, তা ছাড়া থাকে ক্লাস না থাকলে অঘোষিত ছুটি, বৃহস্পতি-শুক্র ছুটি থাকলে বুধবার টাও জুড়ে নিয়ে তৈরী করা "লম্বা সপ্তাহান্তের" ছুটি, আর এমনিতে তো আছে ই দেড়মাস শীতের আর তিন মাস গরমের ছুটি! কিন্তু এই প্রথম বুঝলাম ছুটির আসল আনন্দ কখনই একা একা উপভোগ করা যায় না, হাজার অলস সময় ও শুধু বই নিয়ে কাটানো যায়না, অনেক সময় একা থাকার সময় কাজ ও যেন কাঙ্খিত সহচর হয়ে ওঠে ! বুঝে পাই না ছুটির মানে টা হঠাত এরকম পাল্টে গেল কিকরে, নাকি আমি ই কখন পাল্টে গেছি? অনেক?






বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

মেঘলা মন

আবার সকাল থেকে আকাশ ঘিরে কালো মেঘ, বৃষ্টি এলো চরাচর অন্ধকার করে; আর অমনি আমার মনের ভিতর এতদিনের ঘুমিয়ে থাকা  নিজেকে  নিজের  মতন  করে কিছুক্ষণ  পাবার  ইচ্ছেটা  আবার জেগে উঠলো ...to-do list এর কড়া শাসন আর কর্তব্যের চোখ-রাঙ্গানি র বিরুধ্যে বিপ্লব করে উঠলো আমার সমস্ত সত্তা...আর অনেক অনেক দিন পর চলে এলাম পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে ভাগ করে নেওয়ার এই আঙ্গিনায়... 
ছোটবেলায় "আমার প্রিয় ঋতু " লিখতে দিলে মাঝে মাঝে শরত মাঝে মাঝে গ্রীষ্ম লিখতাম (প্রথম টা যে কোনো বাঙালি শিশুর একটা অনিবার্য পছন্দ, আর দ্বিতীয় তে কবিত্ব বা "অন্যরকম" হবার প্রেরণা যতটা না আছে তার চেয়ে বেশি আছে আম-কাঠালের তীব্র আকর্ষণ,স্বীকার করতে লজ্জা নেই :P )...কিন্তু কলকাতা ছেড়ে দিল্লি যাবার পর বুঝলাম নিজেকে ই চিনতাম না এদ্দিন, শরত না, গ্রীষ্ম না, এমনকি কোনদিন কলকাতায় চোখে না দেখা "হেমন্ত" ও না, আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু হচ্ছে বর্ষা...কলকাতার থেকে চরিত্র আলাদা হলেও গ্রীষ্ম সব জায়গাতেই আছে (অনেক জায়গায় নেই ও, কিন্তু সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তেমন জায়গায় কক্ষনো থাকিনি), শরতের মত  পেজা  তুলো-মেঘ আমি অস্টিন এও কতবার দেখেছি,সঙ্গে নির্ভেজাল কাশফুল! কিন্তু কলকাতার মতন অমন বর্ষা আর দেখিনি....অমন সারাদিন ঝিরঝির ঝমঝম একটানা অবিরল, অমন ণীল মেঘের স্তুপ আর তার ছায়ায় বিষন্ন গোটা শহর,অমন যখন তখন এক লাফে এসে শহরের মালিকানা ছিনিয়ে নেওয়া দুরন্ত বর্ষা....আর  কোনো ঋতুই কি পারে আমার শহরের চরিত্র এক নিমেষে এত টা বদলে দিতে? আর কোনো ঋতু ই কি আছে যার জন্যে এত আগ্রহ নিয়ে পথ চেয়ে থাকি? 
দিল্লি তে প্রথম যখন যাই কলকাতায় তখন  ঘোর বর্ষা..কিন্তু দিল্লি তে মেঘের চিন্হ ও নেই..মাঝে মাঝে এক একদিন বৃষ্টি আসত,মন টা নেচে উঠত যেন বাড়ির চিঠি এলো...শুনেছিলাম সেবারে দিল্লির তুলনায় অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু আমার গাঙ্গেয় মন তাতে তৃপ্ত হয়নি... এই বিদেশে  বৃষ্টি আসে চকিতে, মেঘ হয়ে মুখ ভার করে থাকে যখন আকাশ তখন ও সে যেন লঘু ক্ষিপ্র মেঘ, এই এলো এই চলে যাবে; সে মেঘ "গাভীর মত চরে" না, সে মেঘ মনের সপ্তকে মল্লার বজায় না...ঝিরঝির বৃষ্টি সারাদিন ঝরে ঝরে কখনো বিরক্তি কখনো গান জাগে না, ভাবি ভাগ্যে কবিগুরু বাংলাদেশে জন্মেছিলেন,  নৈলে  এত বর্ষার গান পেতাম ই বা কোথায়?
যাই হোক, আজ যখন অকাল বর্ষা এসেই গেছে আমার ঝাপসা জানলার ক্নাচে, এই বেরন্গিন মেঘলা আকাশে, তখন সব কাজ ফেলে আজ বর্ষার কাব্য ই করি..দেখি যদি এই মেঘ কে অলকা না হলেও আমার প্রিয় শহর টাতে পাঠানো যায়: "যাও মেঘ বলে দাও আমি ভালো নেই".....

মঙ্গলবার, ৩ এপ্রিল, ২০১২

সকাল থেকে সারা দুপুর/ইট সাজিয়ে ইটের উপর/খেয়াল মত দেয়াল তুলি গড়ে...

হঠাত হঠাত ইচ্ছে হয়  না, আমি  যদি আমি না হয়ে অন্য কেউ হতাম ভাবতে? কেমন হত জীবন টা--কোন নিয়মে ব্নাধা থাকত  আমার চলা-বসা--কারা থাকত আমার চারপাশে...এখন এই বিকেল এ বসে বসে আমার এরকম ই একটা ভারী অদ্ভূত ভাবনা আসছে--শুনে আমায় বদ্ধ পাগল ভাবা টা একদম ই ন্যায্য, এমনকি আমার নিজের ও ঘোরতর সেই সন্দেহ ই হচ্ছে, তবু মনে হচ্ছে যখন, লিখেই ফেলি.. 


দুপুরে হঠাত ই গুনগুনিয়ে মনে এলো ছোট্টবেলার কবিতা: "আমি যে রোজ সকাল হলে/যাই শহরের দিকে চলে/তমিজ মিয়ার গরুর গাড়ি চড়ে"..হঠাত ই ভীষণ ইচ্ছে করলো: আমি যদি এমনি কেউ হতাম? সকাল হতেই কোনো ছুচলো-দাড়ি-চেক-লুঙ্গির তমিজ মিয়ার গরুর গাড়িতে চড়ে চলে যেতাম শহরের দিকে..হয়ত আমার বাড়ি মফস্বল এ,হয়তো একতলা খোলার ঘর, সামনে একফালি মাটির উঠোন, বউ যত্ন করে দুটো লঙ্কাগাছ জবাগাছ লাগিয়েছে বেড়ার ধার ঘেষে, যাবার সময় সে বুঝি খোদাতালার কাছে দুয়া মেগে নয় রোজ একবার..
হয়ত আমার পাড়ার পথ টা ভাঙ্গাচোরা মাটির,ক্য়াঁচ কন্চ করতে করতে গরুর গাড়ি এগিয়ে যায় শালুক-ভর্তি ডোবা টার পাশ দিয়ে..গরুর গাড়ির জমানা যখন তাহলে হয়ত পাশের মাঠ টা খালি ই পরে আছে বিকেলে ছেলেদের ফুটবল খেলার জন্যে, গোসাইতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় টা নিশ্চয় তখন ওঠেনি, বা কোনো প্রমোটার এর স্তুপিকৃত বালির তলাতেও হারিয়ে যায়নি মাঠ টা..সেই মাঠ পিছনে রেখে  আমার গাড়ি ওঠে পাকা পথ এ , মুখের মুদির দোকান থেকে রহিম-চাচা হাত নাড়ে রোজকার মত..শুরু হয়ে যায় আমার দিন..


শহর কেও তো আমি দেখি অন্যভাবে, আধা-সমাপ্ত বাড়ির ছাত পেটানোর ফাকে দেখে নি নিচে বিছিয়ে থাকা শহর, তার দুপুরের ভাতঘুম টুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি আমার তিন তলার ছাদ থেকে..পাশের স্কুল এ ছেলে রা নামতা পড়ে কেমন একঘেয়ে আওয়াজ এ ..রাস্তা থেকে হাক শোনা যায় বাসন চাই বা শিল কাটাবে-র.. বাড়ির থেকে রান্নার আওয়াজ থেমে যায় ,বাড়ির  মেয়েদের গলাতেও নেমে আসে ঝিম-ধরা মৃদুতা...মাঝের উঠোনে বাসন জমা করে রেখে ছায়া-ছায়া অন্দরে চলে যায় বড়বৌ-সেজবৌ রা...বুঝি ওবাড়ির কোনো ছেলেমানুষ বউ এই অবসরে একটা নভেল হাতে উঠে আসে ছাদ এ, মাদুর পেতে রোদে পিঠ দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে..দেখি ডুরএ-শাড়ি-বেণী-দোলানো মেয়েটি মায়ের পানের ভাগ নিতে উঠে আসে ছাদে,অমনি বায়না ধরে গল্প বলার..মা-ও বুঝি আনমনা হয়ে শুরু করে দেয় নিজের অনতিপূর্ব বালিকা বেলার কথা..নিঝুম দুপুরটার সঙ্গে মিশে গিয়ে আমি ঢালাই করি ছাদ আর দেখি...আমার ও জানতে ইচ্ছে করে আমার সেই লঙ্কাগাছের বেড়ার ঘরটিতে আমার আমিনা এখন কি করছে,নিদ্রা-অলস দুপুরে আমার পারা ও কি এমন ই নিঝুম হয়ে ওঠে? 




মন-কেমন করা  বেলা ঢলে পড়ে, শহরের আকাশে  গোধুলির  রং  ধরে...আলসেমি ছেড়ে উঠে বসে পারা টা..কলে জল এসে যেতেই  বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয় ব্যস্ততা..ঝি এসে পড়ে, সদ্য -ঘুমভাঙ্গা মুখে  চুলগুলো এলো খোপায়  জড়িয়ে  নিতে নিতে আবার সংসারের কাজে লেগে পড়ে বড়বৌ..ওবাড়ির ছাদ থেকে মা-মেয়ে  নেমে আসে,গা ধুয়ে অপেক্ষায় থাকে অফিস্বাবুটির ফেরার..পাশের স্কুল বাড়ির ছেলেরা ঘন্টার আওয়াজ হতে না হতে ঝরনার মত নেমে আসে পথ এ,তাদের কোলাহল এ কোথায় মিলিয়ে যায় স্তব্ধ দুপুর টা ... পাখিদের মত নীড়ে ফেরার নেশায় আমিও নেমে আসি ভারা বেয়ে, জলদি পায়ে হাটা লাগাই মোড়ের দিকে, যেখানে তমিজ মিয়া দাড়িয়ে আছে টার গাড়িটি নিয়ে..আবার সেই পথ, আবার সেই মোড় ঘুরে কাচা-সড়কে উঠে পড়ি...হঠাত কি মনে হতে মুদির দোকান থেকে দু পয়সার মুড়কি কিনে নি তারপর আবার সেই মাঠ সেই ডোবা আর রাস্তার ধারে বেড়ার ফাকে আমিনার অপেক্ষারত চোখ--যার জন্যে সারাদিনের খাটুনি গোলামী সব সয়ে যায়, আরো একটা দিন বেচে থাকার ভারী ইচ্ছে করে..


 এমন যদি হত আমার জীবন? এইসব জটিলতা আরো চাওয়া আরো পাওয়া র থেকে অনেক দুরে এক চত্ব জীবন, ছোট সুখ ছোট আশায় ভরপুর..?আজকের সন্ধ্যেতে কেন যে সেই না-পাওয়া জীবন না দেখা মফস্বল না বোঝা সরলতার জন্যে মন কেমন করছে...বললাম না, উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি কিনা নিজের ই ঘর আশংকা.. 



শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

"radio তে হঠাত একটা পুরনো গান..."

জ্বরের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জ্বর মানুষ কে তার একান্ত প্রিয় জিনিসগুলি বা মানুষ গুলি কে চিনিয়ে দেয়-- জ্বর হলে যেমন করে বুঝি মা কে কতটা ভালোবাসি তেমন আর কখনো না-- তেমনি আজকের এই জ্বরের শেষে সুর্য ধওয়া ঘরের মত এসে হাজির হলো আমার খুব প্রিয় কিছু গান, "আধুনিক" বাংলা গান..


এই "আধুনিক" শব্দ তে চিরকাল ই আমার খুব কৌতুহল--চল্লিশের দশকের গান ও যদি "আধুনিক" হয় তো পুরনো বলে আর রইলো টা কি? আসল কারণ যাই হোক না কেন, নিজের মত করে যে কারণ টা আমার পছন্দ হয় সেটা হলো এ গান গুলো আধুনিক কারণ আজ সত্তর বছর পেরিয়ে আধুনিক মনেও এর আবেদন সমান, "আধুনিক" কেননা "পুরনো" হবার নয়...পুরনো হবেই বা কিকরে?এ গানের যে পরতে পরতে মিশে আছে আমার, হয়ত আমারি মত কত  জনের বড় হয়ে ওঠা..মিশে আছে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া কত স্মৃতির উত্তরাধিকার...সময়ের ধুলো যাকে কোনো দিন ও মলিন করতে পারবে না...
"আধুনিক" গান এর, বা গান শোনার ই হাতেখড়ি আমার বাবার কাছ থেকে।খুব ছোট্টবেলার কথা মনে আছে গ্রীষ্মের সন্ধ্যা, আমাদের পুরনো বাড়িটার বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছে আসর, দিনের শেষে সবাই কাজ সেরে এসে বসেছে আর বাবা তন্ময় হয়ে গেয়ে চলেছে একটার পর একটা হেমন্ত..সেই হু-হু  হাওয়া,আনাচে-কানাচে ভয়ের বাসা বেধে-থাকা পুরনো অন্ধকার বাড়িটা , আর চারদিকে ভারী আপন কিছু মানুষ--স্মৃতি-পূর্ববর্তী যুগের এই স্মৃতি তাই কিকরে যেন রয়ে গেছে...পুরনো সেই বাড়িটা কতদিন ই ছেড়ে চলে এসেছি, সেই আপন মানুষজনের অর্ধেক ই এখন আর নেই, দায়িত্ব আর বাস্তবের চাপে বাবার গলা থেকেও কখন হারিয়ে গেছে গান, শুধু ওই সন্ধ্যে গুলো রয়ে গেছে এখনো "অলির কথা শুনে বকুল হাসে" কিম্বা "কোনো এক গায়ের বধুর " এর সুরে  সুরে...


স্কুল এ পড়ার সময় প্রেমে পড়ে গেলাম "আধুনিক" গানের..মাঝে মাঝেই ব্যস্ত দিনের শেষে বাবা আর আমি আলো নিভিয়ে শুনতাম সেইসব কাসেট : অন্ধকার ঘরে পুরনো কলকাতার একঝলক হাওয়া বয়ে যেত: "এত সুর আর এত গান" , "আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে" বা "আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি" র গভীরতায় ডুবে যেতাম যেন, অপূর্ব কথা আর বিষন্ন-গম্ভীর ভরাট গলায় সব কটি কথার  যেন আরো বেশি করে বাঙ্ময় হয়ে ওঠা--আমার সেই নতুন ভাবতে শেখার কালে এই সময় গুলো খুব সুন্দর খুব উজ্জ্বল হয়ে আছে। আর ছিল স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় S -২১ বাস--তখন বাস এ FM লাগেনি,কিন্তু ওই সরকারী রুট টায় দুজন চালক নিজেদের খরচে দুটো বাস এ tape-recorder বসিয়েছিলেন..আর তাদের ও পছন্দের ছিল বাংলা আধুনিক। যেসব দিন স্কুল থেকে ফেরার বা স্কুল যাওয়ার সময় ওই দুটো বাস এর একটা পেতাম, উত্তর কলকাতার কুখ্যাত যানজট, ধুলো-ধোয়া, স্কুল এর ক্লান্তি সব কিছু রঙিন হয়ে উঠত সন্ধ্যা বা লতাজী র কন্ঠের জাদু তে--সেই কোনো বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যে বাস এর বাইরে অফিস ফেরত কলকাতা দেখতে দেখতে "আকাশ প্রদীপ জ্বলে " বা "আমি যে জলসাঘরে" র তুলনা আজ ও খুঁজে পাইনি...


পুরনো গান মানে শুধু তো রোজকার নানান কাজে এমন ভাবে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি না, বা নয় শুধু বাবা-মায়ের মুখে সারারাত-জাগা গানের অনুষ্ঠানের গল্প শোনাও--এই গান গুলো মানে অনেকগুলো ভ্রমনের স্মৃতি ও--আজ ও "মোম-জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে" শুনলেই মনে হয় মানালির সেই রাস্তা--দুরে বরফ-পাহাড় আর পাশে বিয়াস নিয়ে পাকদন্ডি বেয়ে  রোটাং যাওয়ার দিন টা , মনে পড়ে gangtok এ নেপালী চালক "ছান্গ্ছুং দাজ" র সেই "তখন তোমার একুশ বছর" বুঝতে চাওয়ার প্রানপন চেষ্টা, মনে পড়ে gulmarg যাওয়ার মেঘলা আর কুয়াশা-মাখা ভোরে সেই অনবদ্য "বড় একা লাগে"..


আর পাচটা মধ্যবিত্ততার মতই এই গান গুলো আমার উত্তরাধিকার, আমার বড় হয়ে ওঠার সাক্ষী, আমার খুব প্রিয় সহচর...জানি না গানের বিচারে এদের মূল্য কতখানি, কিন্তু আজকের এই জ্বরতপ্ত রাতে উদাত্ত গলায় ওই "আয় খুকু আয়" এর মত করে আমায় ছুটে আর কেউ পারবেনা, আর আমার জন্যে সেটাই অনেক... 



মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১২

এমন দিনে তারে বলা যায়...

বাইরে এখন গুরু -গর্জন আর অঝর বর্ষণ -- চেনা অস্টিন অচেনা রাতপোশাকে রহস্যময়ী--বাতানুকুলতার বাধা পেরিয়ে বৃষ্টির রিমঝিম ডেকে যাচ্ছে আমায়..এমন দিনে নাই বা হলো আমার পড়া-পড়া খেলা, রইলো পড়ে খোলা বই খাতা--আমি চললাম এই বৃষ্টির পথ বেয়ে আমার স্কুল-বেলায়...


স্কুল এর দিন গুলোয় বৃষ্টি কে ভয় পেতাম না মোটে (এখনো পাই না অবিশ্যি :)), ছাতা না আনার দুর্ভাবনা আসতই না মাথায়, বরং ছাতা আনলেও সেটার আড়াল দিয়ে কীকরে ভিজতে হয় সেটা খুব জানা ছিল :) স্কুল এ বর্ষা মানেই ক্লাস এর ফাকে কোনো দিদি কে ডাকতে যাবার ছুতো করে এ-বাড়ি ও-বাড়ি করা--science building  থেকে cristin ভবন আবার ফেরা , তারপর সপসপে ভিজে শাড়ির আচলে মাথা মুছে তৃপ্ত মুখে নিরীহ ভাবে আবার ক্লাস এ..স্কুল এ বর্ষা মানেই cristin বাড়ির বাগান থেকে ভেসে আসা জুই এর মন-উতল করা সুবাস..স্কুল এ বর্ষা মানেই বন্ধুদের সঙ্গে বর্ষার গানের অন্তক্ষরী.....


ক্লাস five এ বসতাম ক্রিস্টিন বাড়িতে..টিফিন এ বৃষ্টি হলে পরের ক্লাস এর দিদি র মেন বিল্ডিং থেকে আসতে অনিবার্য ভাবেই দেরী, আর সেই ফাকে আমাদের বৃষ্টি ভেজা, পরে দিদি এসে অশেষ বকুনি..পড়ার ফাকেও মন চলে যেত সামনের আমগাছ টার পাতায় পাতায় বৃষ্টি ফোটার আওয়াজে বা ভিজে কাকের ডাকে, বাকরণের  পাঠ হারিয়ে  যেত কোথায়..কোনো দিদি আবার এমন দিনে বইপত্র সরিয়ে রেখে কবিতা-গানের আসর বসাতেন সবাইকে নিয়ে, সে এক অন্যরকম আনন্দ...আর থাকত ছুটির সময়  মা দেরী করে নিতে এলে  কাগজের  নৌকো বানিয়ে উঠোনের জমা জলে ভাসিয়ে  দেওয়া..বৃষ্টি হলেই কি যেন এক বাধন ছাড়া আনন্দ চেনা বাস্তব জগতকে উড়িয়ে নিয়ে যেত, কখনো যেন আমি নববর্ষার  সেই ঘটে  বসা অন্যমনা মেয়েটি , কখনো hans anderson  এর টিনের সেই সেপাই যে বৃষ্টির নদী বেয়ে adventure  এ বেরোলো...


দুটো বর্ষার দিন খুব মনে  আছে: একটা দিন, সে অবশ্য বর্ষাকাল  নয়, রীতিমত পচিশে  বৈশাখ ..স্কুল ছুটি  কিন্তু আমাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের  জন্যে রিহার্সাল চলছে স্কুল এ ..এমন সময় আকাশ কালো করে ঝেপে  এলো বৃষ্টি...দিদি রা টিফিন এর সময় অন্যদিকে  গেছেন  ঠাকুর  দালানে আমরা মেয়েরা বসে, হঠাত ই কি থেকে যেন শুরু হয়ে গেল রবীন্দ্র সঙ্গীত আর কবিতা, স্বত:স্ফূর্ত পচিশে বৈশাখ উদযাপন..গানে গানে কবিতায় কখন বিভোর হয়ে গেছি মরা সবাই, দিদি রাও কখন শুনতে পেয়ে এসে যোগ দিয়েছেন, কন্ঠ মিলিয়েছেন বুঝতেও পারিনি..সে বিকেল টা আমার স্মৃতি তে খুব দামী হয়ে রয়ে গেছে..কোনো রবীন্দ্র-স্মরণে আর তেমন স্বত:স্ফূর্ত আনন্দ পাইনি..তখন মন টা থাকত ভারী উচু সুরে বাধা, বাস্তবের করা আচ জানতেই পারিনি স্কুল এর ছায়া-নিবিড় আশ্রয়ে থেকে..আজ সেইসব বিকেল ভারী অলীক বোধ হয়..



আরেকদিন..সে ঘোর বর্ষার দিন..দুপুরে ই হঠাত নেমে এলো রাতের ঘন অন্ধকার..কোন এক ক্লাস এর দিদি আসেন নি, আমরা ক্লাস ঘরে আলো নিভিয়ে সেই অন্ধকারে বসে আছি..তখন ক্লাস টেন, ক মাস পরেই ছেড়ে যাওয়া স্কুল, কে কোন পথে চলে যাবে কোন ঘাটে লাগবে কার তরণী, কেউ জানিনা..বাইরের চরাচর-প্লাবিত সেই অকাল-সান্ধ্য অন্ধকার আর ভিতরে এতদিন এক বৃন্তে বেড়ে ওঠা আমরা কজন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে...ফিসফিস কথা হচ্ছিল, আধ-দু কলি গান..সব জুড়ে গভীর এক অনুভব...টিফিনের পর অঙ্ক ক্লাস--শুক্লা দি আমাদের উচাটন মন দেখে অনুমতি দিলেন, দুটো অঙ্ক করে দেখিয়ে নিলেই আমরা বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখতে পারি..তড়িঘড়ি অঙ্ক করে চলে গেলাম বারান্দায়..আধার-ঘন উত্তর কলকাতা চারদিকে, দুরে উথাল-পাথাল গঙ্গা,মন উদাস করা হাওয়া এ ভেসে আসা বৃষ্টির ছাট--কি যে দেখেছিলাম সেদিন বারান্দায় কে জানে--কেন যে বৃষ্টি বলতেই সেই মন-কেমন করা দুপুর গুলো মনে পড়ে আর বন্ধু বলতেই সেই চুপ করে পাশাপাশি দাড়িয়ে থাকা মুর্তিগুলো তাই বা কে জানে..


সেই গঙ্গা আজ ও বর্ষায় এমনি উত্তাল হয়, সেই স্কুল বাড়িটাও এক ই আছে--শুধু সেই আমি টাকে কোথাও খুঁজে পাইনা.. এমন কোনো বৃষ্টিভেজা রাতে খুব মন কেমন করে--সেই স্কুল টার জন্যে, সেই বন্ধুদের জন্যে,সেই আমি টার জন্যে.......







শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

কলকাতা কলকাতা তেই?

সব কিছু  বদলে  যাচ্ছে...
এমন নয় যে আমায় অকাল-বার্ধক্য গ্রাস করেছে (সে আমি একটু ঠাকুমা-type চিরকাল ই আছি--নিন্দুকে বলে বটে )--কিন্তু  কি জানো , যখন আমাদের চারপাশের জগত তা মতে ভালো লাগে না, যখন ক্লান্তি ঘিরে  ধরে মন, তখন স্বপ্নের মত মনে করতে ভালো লাগে ফেলে  আসা দিন গুলো--আমার শহর, আমার বাড়ি, আমার বন্ধু রা..যেন এক অলীক স্বপ্নের নীড় এর মত সেই দিন গুলো--অথচ তারা আজ ও কোথাও না কোথাও বেচে আছে সেই অনুভূতি তেই নিমপাতা গেলার মতন করে সয়ে নেওয়া যায় বর্তমানের অত্যাচার--আর তাই যখন হঠাত মনে হয় বুঝি সে জগত টা বাস্তবের দুনিয়া থেকে উদাহ হয়ে গাছে; টান  পরে শিকড়ে..ওলট পালট হয়ে যায় অস্তিত্বের ভূমি..হারিয়ে যাওয়ার  ভয় চেপে ধরে...
এমন নয় যে আমি স্থবির, পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম ই যে পরিবর্তন এ কথাটাও আমার জানা নেই এমন নয়. আর সেই পুরনো কালের লোকের মত "সে ছিল আমাদের হেমন্ত এখন কি তোমরা সুমন নিয়ে মাতামাতি কর" জাতীয় বক্তব্যেও আমি একমত নই পুরোপুরি..তবু ...আসলে পরিবর্তন টা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত লয়ে ঘটে যায়--যদি পলক ফেলার মধ্যেই ছিল রুমাল হয়ে যায় বেড়াল তাহলে কি অবাক লাগা বা এমন কি ভয় পাওয়া তাও খুব নিন্দের? 
অবাক লাগে যখন চেনা মিষ্টির দোকান এর জায়গায় ওঠে food -chain  এর ডিলার...যখন চেনা বন্ধু রা ,যাদের সঙ্গে খুচরো গুনতি করে পুটিরাম এ দশ টাকায় কচুরি খেয়েছি কোনমতে, তারা সহজ সুরে অগ্নিমূল্য দোকানে দেখা করার কথা বলে...যখন পাশের বাড়ির কাকিমা facebook এ বন্ধুত্ব পাতাতে চান...যখন আনন্দবাজারের পাতায় পড়ি কলকাতা আজ শীত পোহায় পাকা বিলিতি কায়দায়;পাটিসাপটা-নতুন গুড়-জয়্নগরের মওয়া এ নয়... হঠাত মনে হয় চেনা দুনিয়া টা পাল্টে গেছে, একা আমি ই আমার থেমে যাওয়া সময় কে একরে ধরে বসে আছি বৃথা nostalgia কে সঙ্গী করে..আজকের কলকাতা victoria 's secret এ sale  এর খবর রাখে, ধান্তেরাস আর লোরি উদযাপন করে, আড্ডা মারে নিত্য নতুন shopping  mall এ..অবাক হয়ে খুজতে চেষ্টা করি আমার চেনা শহর টাকে--নিত্য নতুন শিরোনাম এ এই তীব্র গতির, অসাধারণ জেল্লার পরিবর্তন তার আলো  আধার দুই ই নিয়ে আমার চোখে ধাক্কা মারে...


শতাব্দী কাল থেমে থাকার পর হঠাত দৌড়তে শুরু করেছে কলকাতা--তার মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা ছেড়ে, উত্তর কলকাতার অন্ধকার গলি ছেড়ে, তার নন্দন-কফি house  সংস্কৃতি ছেড়ে কলকাতা এগিয়ে গেছে অনেক...আমাদের মত যারা তেমন ভালো দৌড়-বীর নয়; যাদের এখনো বারিস্তা র চেয়ে কফি house এ চায়ের কাপে তুফান তলা আড্ডা ই বেশি প্রিয়, যাদের এখনো স্বাস্থ্য-সচেতন মিলনমেলা র চেয়ে ময়দান এর ধুলিধুসর বইমেলা ই ভালো লাগে, যারা এখনো midnight পার্টি র dress নয়, সরস্বতী পুজোর সারী তেই বেশি স্বচ্ছন্দ তারা থাকুক পিছনে পরে...যতবার ফিরে যাব অপেক্ষায় থাকবে আরো আরো বদলে যাওয়া একটা  কলকাতা...     

বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

রাত এবং..

এখন আরো একটা রাত নেমেছে অস্টিন শহরের বুকে..আরো একটা রাত, যার স্পর্শ এসে পৌছয় না আমার কাছে এই কাঁচের জানলা পেরিয়েআরাতানুকুল ঘরের মধ্যে..শুধু জানলা দিয়ে দেখি আলোকিত রাস্তার বুকে বিনিদ্র truck  এর গতি..শুনতে  পাই পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলে যাবার  শব্দ; যেন একখন্ড গতি হয়েই  আমার কানে  এসে আঘাত করে..বাইরে বসন্তের  মৃদু হাওয়া, পাশের বাড়ির বাগানের গাছ গুলোর  ফাকে  বাতাস  খেলা  করার  মর্মর--ভিতরে  সুধু একটা কৃত্রিম তাপমাত্রায় বসে আছি আমি..মন কেমন করে কলকাতায়  ফেলে আসা আমার সেই  রাত গুলোর জন্যে...


এই রকম সময়ে , যখন শীত চলে গাছে গরমের আসতে  দেরী  আছে , তখন  ই  কলকাতার রাত গুলো সবচেয়ে  সুন্দরী  হয়ে  ওঠে ..আমার বাড়ির পাশের দোতলা পুরনো  বাড়িটার  ছাদ  ভেসে  যায়  জ্যোত্স্না  আর মিঠে হাওয়ার  সরতে, আমার চেনা দুধ-সাদা বেড়াল টা আরামে গা এলিয়ে শুয়ে  থাকে --ছাদে গজিয়ে ওঠা মস্ত  বড়  বট গাছ টায় ঘুমন্ত পাখির  ছানা  বুঝি  বা  ভয়ের  স্বপ্ন  দেখে  জেগে  উঠে বার দুই ডাক  দায় , একটু  পাখার  ঝাপট --কি  জানি  কোন  রাতচরা  পাখি  অদ্ভূত  মন কামনার  সুরে  ডাকতে  ডাকতে  উড়ে  যায়  মাথার  ওপর  দিয়ে--আর রাত আড়াই টে  নাগাদ আমাদের গুরুদাস  hault  station  এ ব্নাশী বাজিয়ে  ছেড়ে  দায়  কোন  এক দুরপাল্লার ট্রেন,তার ঘুমন্ত বুকে চেপে  আমার মনটাও  বেরিয়ে পরে মানস-ভ্রমনে...
এরকম রাত মানে  অল্প কিছু পড়ার ভান আর বারবার বারান্দায়  দাড়িয়ে থাকা বা জানলা দিয়ে অপলক চেয়ে থাকা--ওই রাস্তা দিয়ে নারী কুকুরটা নি:শব্দ পায়ে পারা ঘুরতে বেরোলো বুঝি--ওই কাদের বাড়িতে এখনো এল জ্বলছে কাকিমার  ঘুম আসেনি নিশ্চয় আজ ও..আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে একটা শিরিষ গাছ আছে, যার পাতাগুলো  সন্ধ্যে হলেই নুয়ে  পড়ে ঝাড় লন্ঠনের  মত দেখায়..ছোটবেলায় তার  ছায়া তে ভয় পেতাম  পরে ওই দুলন্ত ছায়াগুলো  ও আমার রাতের অংশ হয়ে গেল..এরকম রাত মানে walkman  এ প্রিয় গান শুনে সুরের অনুরননে ডুবে যাওয়া , বা কোনো প্রিয় বই প্রিয় চরিত্র  খুব প্রিয় অশ্রু-বিন্দু...


সেই রাত গুলো কবেই ফেলে এসেছি--আজ চার বছর হলো  রোজকার সেই চেনা রাতের ছবি  টা আর দেখিনা..শুধু তার কিছু গন্ধ বুঝি রয়ে গাছে আমার স্মৃতির আনাচে কানাচে--নিঝুম হোস্টেল এর badminton  court  এ তাকে খুঁজে নিতে চেয়েছি,কিম্বা jnu এর ছায়া মাখা  অরণ্য-বীথিতে--আজ ও পাশের গলফ-course  এ চলে যাই সঙ্গী পেলে..আর পৃথিবীর অন্য  প্রান্তে আমার চির -চেনা সেই মধ্য-কলকাতার শান্ত রাত গুলো বৃথাই  ঝরে  যেতে  থাকে--রোজ...







রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

নাম-মাহাত্ম্য

কবি বলে গেছেন নামে কি এসে যায়, কিন্তু বাস্তব হলো খুব-ই এসে যায় অনেক-কিছুই এসে যায়. কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন যেমন হাসির খোরাক হয় জটিল অপ্রচল নাম যেমন সমীহের উদ্রেক করে তেমনি নাম অনেক expectation তৈরী করে. এবার পুজোয় যাওয়ার আগে একজন কর্মন্কর্তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল;নাম রায়ান চৌধুরী. নাম শুনে তো আমরা বেশ ফ্লাম্বয়েন্ট ঝকঝকে এক তরুণ এর অপেক্ষায় বসে আছি--যখন মাথাজোড়া টাক আর নিপাট ভালোমানুষী হাসি নিয়ে খর্বকায় মানুষটি এসে উপস্থিত হলেন আমরা অপ্রস্তুতের একশেষ  :)

আমার নিজের নাম টা আমার কাছে খুব প্রিয়. সত্যি করে এমন একজন যাকে সবাই স্বাগত জানাবে তেমন টি হয়ে উঠতে পারিনি কিন্তু বাবা-মার প্রত্যাশার মর্যাদা রাখতে চেষ্টা জারি আছে জোরদার :) আর এই নাম টার সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সেই ছোট্ট থেকেই এ সম্পর্কে আমি খুব স্পর্শকাতর. সংস্কৃত "স্বাগতা" নাহয় বাংলায় "সাগতা" এ পর্যবসিত হলো তাও সই, কিন্তু ইংরেজি বানানেও যখন sagota হয়ে যেত মেনে নিতে পারতাম না মোটেই. আমার খুব ঘনঘন যাওয়ার একটা জায়গা ছিল ডাক্তার খানা; আর সব ডাক্তার ই বানানের ব্যাপারে এক-ই ভুল করতেন,কাজেই ছোটবেলায় আমার অভ্যেস হয়ে গেছিল ডাক্তার নাম জিগেশ করলে বলে ওঠা s-w-a-g-a-t-a :) লোকে ভাববে পাকামি কিন্তু আমার কাছে তো সেটা অস্তিত্ব-সংকট!
অবশ্য মোটে পছন্দ ছিল না (আজ ও নয়) আমার ডাকনাম গুলো. সংখ্যায় বেশ অনেকগুলো কিন্তু একটাও আমার মনের মত না; তাই বাড়িতে খুব করে বলে দেওয়া ছিল বন্ধুদের ফোন এলে খবরদার যেন আমায় ডাকনামে চেচিয়ে না ডাকে, বলতে হবে "স্বাগতা তোর ফোন" .ছেলেমানুষী কান্ড দেখে বাবা মা যে খুব ই মজা পেতেন তাতে সন্দেহ নেই. এই ক্ষোভ থেকেই ৫ বছর বয়েস এ নিজের ডাকনাম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম "পাপেলা", কেউ ডাকনাম জানতে চাইলে সেটাই বলে দিতাম গম্ভীর ভাবে, কিন্তু মায়ের পাশ থেকে ফিকফিক করে হেসে ফেলা দেখে কেউ আর মেনে নিল না সে নাম টা, আমি সেই পচা ডাকনামেই ডাকিত হতে থাকলাম :(

নিজেকে সর্বশক্তিমান মনে হলো ক্লাস ২ তে,বোন এর নামকরণের দায়িত্ব বাবা মা দিয়ে দিল আমাকে! নেহাত ই বাচ্চা তখন আমি নইলে দেখিয়ে দিতাম ভালো নাম কাকে বলে, কিন্তু যেটা ঘটল সেটা হলো আমি ছোট্ট বোনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ দেখে নাম দিলাম শতরূপা আর এখনো অবধি এই cliche নাম টা দেওয়ার জন্যে বোনের থেকে অনুযোগ শুনতে হয়. প্রতিশোধ এ আমি ও থেমে থাকিনা অবশ্য--যখন তখন যা-তা নামে দেকে অর ডাকনামের বারোটা ই বাজিয়ে দিয়েছি আমি :)

আরো অনেক ব্যাপারের মত এই ব্যাপারটাতেও রবীন্দ্রনাথ এর ওপর হিংসে হয় আমার: ভদ্রলোক নাম নিয়ে কত experiment  এর সুযোগ ই পেয়েছেন!কেউ কি দেখতে দিয়েছিল যে ওনার দেওয়া নামের বোঝা যে শিশুদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছিল তারা আদৌ তাতে খুশি ছিল কিনা? বা রূপ্বানী র নাম অন্য কিছু হলে সেটা আরও কিছুদিন চলত কিনা? ইশ আমার যদি এরকম এত্ত নাম দেওয়ার সুযোগ থাকত...

বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি..

ছোটবেলার থেকে বড় হয়ে ওঠার একটা খুব খারাপ দিক হলো "choice সেট" তা ছোট হয়ে আসা. এই যেমন ধর "বড় হয়ে কি হবে খুকি?" প্রশ্ন টার উত্তর.ছোটবেলায় ছিল কত সম্ভাবনাময়--কখনো লেখক কখনো শিক্ষক কখনো ক্রীড়া-সাম্বাদিক কখনো ভবঘুরে..আর এখন? বড় হতে হতে বুড়ো হওয়ার দিকে এগিয়ে চলেছি; অথচ কিছুই হয়ে উঠতে পারলাম না..এখন নেহাত প্রশ্নটা আর এই আকারে আসে না, নইলে ক্যাবলা ভাবে বলতেই হত "আমি তো বড় হই নি!"

ছোটবেলায় প্রশ্ন টা বেশ কমন ছিল, উত্তর টা অবিশ্যি রোজ ই পাল্টে যেত...কোনদিন মনে হত আর একটু খানি বড় হলেই শংকর এর মত পাড়ি জমাবো চাদের পাহাড়ের দেশে; কখনো অপুর মত স্বপ্ন দেখতাম porto plata এ গিয়ে সমুদ্রগর্ভ থেকে গুপ্তধন খুঁজে আনার; কখনো কলাবতী পড়ে ক্রীড়া-সাম্বাদিক হওয়ার সখ জাগত আবার কখনো school  এর দিদি দের মত সন্ন্যাসী হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে হত শান্ত সমাহিত school বাড়ির ই অঙ্গনে...খুব ছোটবেলায় উত্তর তা দিনে দিনেই পাল্টে যেত, একটু বড় হয়ে বছরখানেক constant থাকত বোধয়...তখন যে অনেক স্বপ্ন দেখা যায়, অনেক ইচ্ছে মনে আসতে পারে; সম্ভব অসম্ভবের ফারাক টা তো তখনও জানায় নি কেউ সেই আমাকে; কেউ তো বলে দেয়নি যে জীবন টা "unconstrained maximization " আদৌ নয়--প্রতি পদে তার উপল-ব্যথিত গতি, প্রতি পদে তার লাভ ক্ষতির খতিয়ান...কেউ বলে দেয়নি বিভূতিভূষণ নিজেই কেন অপু বা শংকর হতে পারেন নি কোনদিন দৃষ্টি-প্রদীপ এর জিতু হয়েই থেমে যেতে হয়েছে তাকেও; কেউ বলে দেয়নি বড় হলে এমন কি তেপান্তরের মাঠ পেরোনোর ইচ্ছেটাও হাস্যকর হয়ে যায়..

সেই অসীম সম্ভাবনার জগত ছেড়ে আজ যখন এই ধুসর পৃথিবীতে বাস, নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি: আমি কি হতে চাই (বড় হওয়ার আর বয়েস নেই, তাই ওই অংশটা উহ্য ই থাক )? উত্তর মেলে না; চারিদিকে ছড়িয়ে আছে অসংখ অসমাপ্ত কাজের জঞ্জাল--অনেক অনেক কিছু "to do " রয়েছে জমা--জীবন টা কেমন কাটবে সে সম্বন্ধেও একটু একটু করে একে তুলছি ছবি--কিন্তু কি হতে চলেছি সে প্রশ্নের উত্তর ডুবে আছে প্রশ্নচিন্হের জঙ্গলে,অসীম বিভ্রান্তির আবর্তে...একটা একটা করে দিন আরো যেন কুয়াশা র রং লেপে দিছে আর ভুলিয়ে দিতে চাইছে আমার পরিচয়, আমার স্বপ্ন, আমার ইচ্ছেগুলোকে...

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১২

ঘাসের ওপর কিছু শিশিরের কান্না জমে আছে
আহত পাখির ব্যথা -- বুঝি কিছু মেঘক্লান্ত ভোর
বুঝি বা না বলা কথা না ঝরা বৃষ্টির ভেজা চোখ
ছোট্টবেলার কোনো পুষে রাখা মৃদু অভিমান
জমে আছে...জমে থাকে...মনে রয়ে যায়....

কখনো সকাল হলে মনে আসে অবিশ্রান্ত মেঘ
কে যেন রাখেনি কথা--কে যেন খেলার ছলে কবে
দুদিনের খেলাঘর ফেলে গেছে গোধুলি আলোতে
কে যেন আসবে বলে প্রতিক্ষায় ছিনু সারাবেলা
অ-বাক বেদনা জমে...কুয়াশায় ভিজে যায় মন...

পৃথিবী নিজের মত ঘড়ির কাটার মাপে চলে
আমি যদি থেমে যাই? আজ এই মন্থর দুপুরে
আমি যদি নাই ভাবি লাভ-লোকসান, ক্ষয়-ক্ষতি..
থেমে থাকি অবিরাম থেমে থাকি নিজের খেয়ালে?
যাক না পৃথিবী আজ আমাকে অনেক পিছে ফেলে
শুধু তুমি থেকো এই বেদনাক্লান্ত অবসরে
আমি একা বুনে যাব ব্যাথারং তোমার আচলে ... 

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...