বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

দূরে কোথায়

নিজের দুনিযাটুকুর কাছে থাকার একটা নেশা আছে সন্দেহ নেই, ঘাটের নৌকো বাঁধা থাকতে থাকতে ঘাটকে ভালো তো বেসেই ফেলে; কিন্তু হঠাত একদিন, যখন জোয়ারের ছলাত ছল এসে লাগে তার শরীরে, ঘাটের রশি তে পড়ে টান। দূরের টানে ছটফটিয়ে ওঠে মন, স্বপ্ন দেখতে থাকে না জানা সমুদ্রের, না চেনা দ্বীপের। আমার দিন-রাতে এখন সেই অপেক্ষার সুর, দূরের অপেক্ষা। যেন বাঁশি বেজে গেছে, ধোয়া ছেড়ে অপেক্ষা করছে ছোট্ট ট্রেন, চেনা স্টেশন ছাড়ার মুহূর্ত এসে গেল বলে।

এর পর কু-ঝিকঝিক যাত্রা। এর পর অন্ধকার রাতের বুক চিরে হিসহিসিয়ে ছুটে যাওয়া ট্রেন এর গতিময়তা। রাতচরা পাখির মত উদাস করে দেওয়া বাঁশি বাজিয়ে হঠাত হল্ট স্টেশন। তার ও পরে, না জানি কত পরে, একটা স্টেশন আসবে, নতুন ফোটা আলোয় মলিন হয়ে আসা পথদীপ পড়তে দেবে না নাম, ঘুমভাঙ্গা ক্লান্ত চোখে দু-চারজন নেমে আসবে এ-কামরা সে-কামরা থেকে, কেউ কেউ হট্টগোল শুরু করবে ট্রেন কি আরো দূর যাবে না, সেই নিয়ে। কুলি আর টাক্সি-চালকের পাতলা ভিড় ঠেলে বেরিয়ে পড়ব। সামনে একটা পুরনো আমলের ব্রুহাম দাড়িয়ে, আমি জানি, আমারই জন্যে। পিছনের আসনে বিছিয়ে দেব ক্লান্ত শরীর, উর্দি-পরা চালক তো জানবেই আমার কোথায় যাবার ছিল... 

তারপর পথ চলা, সবে ঘুম ভাঙ্গা সকালকে গায়ে মেখে যাত্রা। যেমন সকাল আমি হয়ত আগে কক্ষনো দেখিনি, যেমন সকাল হয়ত আগে আসেইনি এই পৃথিবীতে। শহর ছাড়াতেই প্রান্তর, কিশোর শালবন, ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া মাটির ঢাল।  উজ্জ্বল আকাশের কোলে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে ওঠা নীল পাহাড়ের অবয়ব। মাঝের ছোট বস্তি তে মাটির ভাড়ে এক কাপ অমলিন উষ্ণতা, রংচটা থালায় একটা টোস্ট-অমলেট খেয়েই আবার রওনা।  কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো নাম নেই গন্তব্যের, শুধু ওই নীল অবয়বের পাহাড়ে যেন আমায় পৌছতে হবে।  
                          

তারপর চড়াই এ উঠতে থাকবে পথ, হঠাত বাঁকে একেবারে দৃষ্টিসীমায় চলে আসবে মেঘ-মাথায় ঠায় দাড়িয়ে থাকা পাহাড়... একটা, দুটো, আরো অনেক.... হালকা শীত জড়িয়ে ধরবে কিন্তু আলসেমিতে সুটকেস থেকে শীত-পোশাক বের করা আর হয়ে উঠবে না।  রাস্তার পাশ জুড়ে ঘিরে দাড়াবে পুরু মস এর নরম আস্তর ছাওয়া বর্ষীয়ান পাইনের বন। গাড়ির রেকর্ডার এ বাজতে থাকা আরতি মুখোপাধ্যায় থামিয়ে দিতে বলব এক সময়, গাড়ির ভেতর মেঘের সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে আসবে গাড়ির আওয়াজ ছাপানো ঝি-ঝি র ডাক আর পাহাড়ের নিজস্ব সব শব্দ। পাক্দন্ডির শেষ বাঁক টা পেরিয়ে থামিয়ে দেব গাড়ি, নিচে তখন বিছিয়ে আছে ফিতের মত নীল নদী, ধাপ কেটে কেটে উঠে যাওয়া চারদিকে ঘিরে ধরা পাহাড়ের রাজ্যি-- অনেক নিচে পড়ে সবুজ-ঢালের চা-বাগান, হলদে-গোলাপী-সাদার খেলনা বাড়ির স্তুউপ, কালো সরু পথের দিশা.... অনেক নিচে পড়ে আমার চেনা বাস্তব, চেনা সফলতা, চেনা দু:খ , চেনা রাগ-- অনেক নিচে পড়ে বুঝি আমার কোথাও পৌঁছে যাবার ইচ্ছেটাও। 



স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...