শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

"radio তে হঠাত একটা পুরনো গান..."

জ্বরের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জ্বর মানুষ কে তার একান্ত প্রিয় জিনিসগুলি বা মানুষ গুলি কে চিনিয়ে দেয়-- জ্বর হলে যেমন করে বুঝি মা কে কতটা ভালোবাসি তেমন আর কখনো না-- তেমনি আজকের এই জ্বরের শেষে সুর্য ধওয়া ঘরের মত এসে হাজির হলো আমার খুব প্রিয় কিছু গান, "আধুনিক" বাংলা গান..


এই "আধুনিক" শব্দ তে চিরকাল ই আমার খুব কৌতুহল--চল্লিশের দশকের গান ও যদি "আধুনিক" হয় তো পুরনো বলে আর রইলো টা কি? আসল কারণ যাই হোক না কেন, নিজের মত করে যে কারণ টা আমার পছন্দ হয় সেটা হলো এ গান গুলো আধুনিক কারণ আজ সত্তর বছর পেরিয়ে আধুনিক মনেও এর আবেদন সমান, "আধুনিক" কেননা "পুরনো" হবার নয়...পুরনো হবেই বা কিকরে?এ গানের যে পরতে পরতে মিশে আছে আমার, হয়ত আমারি মত কত  জনের বড় হয়ে ওঠা..মিশে আছে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া কত স্মৃতির উত্তরাধিকার...সময়ের ধুলো যাকে কোনো দিন ও মলিন করতে পারবে না...
"আধুনিক" গান এর, বা গান শোনার ই হাতেখড়ি আমার বাবার কাছ থেকে।খুব ছোট্টবেলার কথা মনে আছে গ্রীষ্মের সন্ধ্যা, আমাদের পুরনো বাড়িটার বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছে আসর, দিনের শেষে সবাই কাজ সেরে এসে বসেছে আর বাবা তন্ময় হয়ে গেয়ে চলেছে একটার পর একটা হেমন্ত..সেই হু-হু  হাওয়া,আনাচে-কানাচে ভয়ের বাসা বেধে-থাকা পুরনো অন্ধকার বাড়িটা , আর চারদিকে ভারী আপন কিছু মানুষ--স্মৃতি-পূর্ববর্তী যুগের এই স্মৃতি তাই কিকরে যেন রয়ে গেছে...পুরনো সেই বাড়িটা কতদিন ই ছেড়ে চলে এসেছি, সেই আপন মানুষজনের অর্ধেক ই এখন আর নেই, দায়িত্ব আর বাস্তবের চাপে বাবার গলা থেকেও কখন হারিয়ে গেছে গান, শুধু ওই সন্ধ্যে গুলো রয়ে গেছে এখনো "অলির কথা শুনে বকুল হাসে" কিম্বা "কোনো এক গায়ের বধুর " এর সুরে  সুরে...


স্কুল এ পড়ার সময় প্রেমে পড়ে গেলাম "আধুনিক" গানের..মাঝে মাঝেই ব্যস্ত দিনের শেষে বাবা আর আমি আলো নিভিয়ে শুনতাম সেইসব কাসেট : অন্ধকার ঘরে পুরনো কলকাতার একঝলক হাওয়া বয়ে যেত: "এত সুর আর এত গান" , "আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে" বা "আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি" র গভীরতায় ডুবে যেতাম যেন, অপূর্ব কথা আর বিষন্ন-গম্ভীর ভরাট গলায় সব কটি কথার  যেন আরো বেশি করে বাঙ্ময় হয়ে ওঠা--আমার সেই নতুন ভাবতে শেখার কালে এই সময় গুলো খুব সুন্দর খুব উজ্জ্বল হয়ে আছে। আর ছিল স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় S -২১ বাস--তখন বাস এ FM লাগেনি,কিন্তু ওই সরকারী রুট টায় দুজন চালক নিজেদের খরচে দুটো বাস এ tape-recorder বসিয়েছিলেন..আর তাদের ও পছন্দের ছিল বাংলা আধুনিক। যেসব দিন স্কুল থেকে ফেরার বা স্কুল যাওয়ার সময় ওই দুটো বাস এর একটা পেতাম, উত্তর কলকাতার কুখ্যাত যানজট, ধুলো-ধোয়া, স্কুল এর ক্লান্তি সব কিছু রঙিন হয়ে উঠত সন্ধ্যা বা লতাজী র কন্ঠের জাদু তে--সেই কোনো বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যে বাস এর বাইরে অফিস ফেরত কলকাতা দেখতে দেখতে "আকাশ প্রদীপ জ্বলে " বা "আমি যে জলসাঘরে" র তুলনা আজ ও খুঁজে পাইনি...


পুরনো গান মানে শুধু তো রোজকার নানান কাজে এমন ভাবে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি না, বা নয় শুধু বাবা-মায়ের মুখে সারারাত-জাগা গানের অনুষ্ঠানের গল্প শোনাও--এই গান গুলো মানে অনেকগুলো ভ্রমনের স্মৃতি ও--আজ ও "মোম-জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে" শুনলেই মনে হয় মানালির সেই রাস্তা--দুরে বরফ-পাহাড় আর পাশে বিয়াস নিয়ে পাকদন্ডি বেয়ে  রোটাং যাওয়ার দিন টা , মনে পড়ে gangtok এ নেপালী চালক "ছান্গ্ছুং দাজ" র সেই "তখন তোমার একুশ বছর" বুঝতে চাওয়ার প্রানপন চেষ্টা, মনে পড়ে gulmarg যাওয়ার মেঘলা আর কুয়াশা-মাখা ভোরে সেই অনবদ্য "বড় একা লাগে"..


আর পাচটা মধ্যবিত্ততার মতই এই গান গুলো আমার উত্তরাধিকার, আমার বড় হয়ে ওঠার সাক্ষী, আমার খুব প্রিয় সহচর...জানি না গানের বিচারে এদের মূল্য কতখানি, কিন্তু আজকের এই জ্বরতপ্ত রাতে উদাত্ত গলায় ওই "আয় খুকু আয়" এর মত করে আমায় ছুটে আর কেউ পারবেনা, আর আমার জন্যে সেটাই অনেক... 



৩টি মন্তব্য:

  1. আহ, মোম জোছনা...পাহাড়ি পথ...আর সরু চোখ আর দরাজ হাসিওয়ালা গাড়ির ড্রাইভার। কিলার কম্বো। তোমার বাবা গান গাইতে পারেন বুঝি? এটা ছোটবেলার পক্ষে একটা ভালো ব্যাপার।

    উত্তরমুছুন
  2. gaan gaite paren mane oshikkhito potutto ar ki...kintu amar khub bhalo lage :)

    উত্তরমুছুন
  3. জ্বর এর সময় প্রিয়জনের ব্যাপারটা আমিও বেশ উপলব্ধি করেছি | একদম তিন সত্যির মত সত্যি ব্যাপার |
    এই সব আধুনিক গান আমার বেশ মনের মত | অলির কথা শুনে বকুল হাসে...কি সুন্দর সব |
    আগেরকার এরকম বাস ছিল জানতাম না | তবে কি ভাগ্গিস দোতলা বাসে দু একবার চড়ে ফেলেছি |
    তবু কলকাতার রেডিও আমার খুবই প্রিয় | হিন্দি-ইংরেজি গানের সাথে বাংলাটা না শুনতে পেলে যে কি অরুচি ধরে তা কানপুরে এসে বুঝেছি |
    বাড়িতে গানবাজনার আদর থাকলে অনেক সুন্দর একসাথে জড়ো হয় ঠিকই |

    উত্তরমুছুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...