বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

গল্পের মত ..ঈশ্কুল্ বাড়ি টা ...

অনেক দিন লিখি করেও এই লেখাটা লেখা হয়ে ওঠেনি, দু-এক পংক্তির পর ই পছন্দ হতে চায়না, মুছে দিতে হয়। আজ আবার বসেছি মনের মধ্যে একঝাঁক কথা নিয়ে, আমার স্কুল কে দেব বলে--আমার স্কুল এর ছবি আঁকব বলে ...
রূপকথা সবাই পড়ি বটে, কিন্তু সবার জীবনে রূপকথা আসে না; হয়ত এলেও তখন খেয়াল করে চিনে নেওয়া যায় না তাকে, এতটাই বাস্তব হয়ে থাকে সে জীবনে জড়িয়ে। আমার, আমাদের স্কুলবেলা তা ছিল এমনি এক রূপকথার অংশ--তখন সে এমন করেই জড়িয়ে ছিল অস্তিত্বে, তাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে ই নিতে শিখেছিলাম, কখনো তার বিশেষত্ব টের ই পাইনি। তারপর সেই ঠাকুর-দালান, সেই সিং-দরজা, সেই নিকোনো উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে এলাম যেদিন, বাইরের দুনিয়াটার পানে চেয়ে বুঝলাম, অজান্তেই কি স্বপ্নিল একটা ছোটবেলা পেয়েছি স্কুল এর কাছে। সেদিন থেকেই স্কুল মানে এক তীব্র nostalgia, এক অদ্ভূত মন-কেমন, এক অন্যরকমের প্রাপ্তি ...

ছোট্ট সেই এক চিলতে স্কুল, পুরনো কলকাতার গন্ধ মেখে গলির মধ্যে অন্তরীণ--না আছে খেলার মাঠ, না আছে বাইরের দুনিয়ার কাছে বুক ফুলিয়ে দাড়াবার কৌলিন্য--কিন্তু শতাব্দী-প্রাচীন সেই বাড়িটাতে কি যে আশ্চর্য সম্মোহন, অচেনা মন-খারাপের বিকেল গুলোয় আজ ও ডাক দেয় সেই ঠাকুর-দালান, সেই ক্রিস্টিন বাড়ির বাগান। সে স্কুল যেন কোনো বাস্তব পৃথিবীর জমিতে দাড়িয়ে নেই, তার আনাচে কানাচে জমে থাকা সাম গানের সুর, তার প্রতিটি দিনের মধ্যে মিশে থাকা শিক্ষয়িত্রী দের সস্নেহ শাসন--সে এক অলীক জগত। হাজার নিয়ম-অনুশাসন ছিল, ছিল হাজার বকুনি-শাস্তি র ভয়, পড়া না পারার দুকখ, সারাদিনের পর ক্লান্ত শরীরে ভারী bag এর বোঝা--কিন্তু তার ই মধ্যে কখন যেন মনের মধ্যে একটু একটু করে ঢুকে পরেছে গোটা স্কুল টা। এখন যখন ছুটির দিনে দেখা করতে যাই, চুপ করে বসি ঠাকুর-দালান কিম্বা ভিতরের ঠান্ডা লাল মেঝের বারান্দায়, মনের পর্দায় ঢেউ তুলে যায় কত না দৃশ্য : ওই তো আমি লাল-পাড় সাদা শাড়ী পরে বারান্দায় বসে অনুষ্ঠানের রিহার্সাল এ; কবিতার একটা পংক্তি কিছুতেই প্রভাতিদির মনমত হচ্ছে না--ওই তো আমি ক্রিস্টিন বাড়ির পথে কাক-ভেজা হয়ে চলেছি ছাতা হাতে দোলাতে দোলাতে; এই বুঝি কাকলি দি দেখতে পেয়ে গম্ভীর এক ধমক দেবেন--ওই তো আমরা কজন map-ঘরের মধ্যে; মানসীদি জুড়ে দিয়েছেন আমাজনের জঙ্গল নিয়ে ভৌগলিক গল্প--ওই তো ছুটির পর শতাক্ষীর সঙ্গে উত্তেজিত আলোচনা হাজার চুরাশির মা নিয়ে; নতুন সব ভাবনার স্রোত দানা বাধতে না বাধতেই আলোচনা কে নরম করে দায় বুঝি শঙ্খ ঘোষের পদ্য--ওই তো সেই মন্দিরের মত চুড়ো টা; স্বাধীনতার দিনে তেরঙ্গা পতাকাটা যার মাথা ছাড়িয়ে স-ও-ও-জা উঠে যায়--আমার চারিদিকে ঘিরে দাড়ায় সেই খেয়াল-খুশির-ক্লাস, সেই পনেরই আগস্ট এর চার্ট বানানো উত্সব, সেই তিনতলার ছাত থেকে দেখা এলোমেলো গঙ্গা ...
স্কুল আমার প্রথম বন্ধন, প্রথম স্বাধীনতা ও; স্কুল আমার কাছে প্রথম সেখা অনেক কিছু, যেগুলো মাঝে মাঝে ভুলে যাই বলেই আজ এত খারাপ থাকি; স্কুল আমার কাছে একদম আমার, একদম নিজস্ব একটা জায়গা, যেটা আমার সব থেকে অন্ধকার সময়েও আমার জন্যে প্রার্থনার প্রদীপ জ্বেলে রাখবে, আমার সব থেকে একলার দিনেও আমায় আপন করে নেবে...আমার সব-টুকু কিশোর-বেলা গচ্ছিত রেখেছি যে তার কাছে... 

৬টি মন্তব্য:

  1. খুব খুব খুব সুন্দর লিখেছ স্বাগতা। মন ছুঁয়ে গেল। আমারও স্কুলটা আমার খুব প্রিয় আর কাছের একটা জিনিস। তাই তোমার অনুভূতি আরও বেশি করে অনুভব করতে পারছি।

    ছবিটা ভীষণ সুন্দর। শিখতে হলে এরকম জায়গাতেই শেখা উচিত।

    উত্তরমুছুন
  2. জায়গাটা অচেনা , কিন্তু গন্ধটা বেশ চেনা | আমি জানি কখনো এখানে | পুরনো কলকাতার গন্ধ যেখানে আর মানসী ম্যাম, কাকলি ম্যাম-রা যখন মানসী দি , কাকলি-দি হয়ে ওঠেন তখন আমার ধারণা এটা সিস্টার নিবেদিতা স্কুল !

    উত্তরমুছুন
  3. :) oboshyoi :) amar school.
    ami kintu apnar school e gechi, (narendrapur RKM to? ) .. khub sundor jayga...

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. হ্যাঁ, আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় অধ্যায় হলো স্কুলের ওই আট বছর | আপনি নয় , ছোটদের তুমি ভালো মানায় |

      মুছুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...