শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪












আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব।

দিন ৪: ছিতকুল- রিকাঙ পিও - কল্পা 

দুদিনের জিরান ছেড়ে আবার আমরা পথে, কিন্নর দেশের শেষ স্টেশন কল্পা। চলার পথ ফিরবে সেই রকছম সাংলা পেরিয়ে কার্চম অবধি, তারপর বসপা কে ছেড়ে আমরা আবার ফিরে যাবো শতদ্রুর তীরে, পাহাড় বেয়ে উঠে যাবো রিকাঙ পিও, তারপর আরো ওপরে কল্পা। সকালের আলো ঝলমলে পাহাড়-ঝর্ণা পেরিয়ে পিও পৌঁছলাম তখন সূর্য মধ্যগগনে। কিন্নরের সদর শহর পিও, তার মিষ্টি নামের মতোই, পাহাড়ের গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ভারী সুন্দর, ভারী মিষ্টি। সামনের আকাশছোঁয়া পাহাড়ের রূপ দেখতে দেখতে দুপুরের খাওয়া আর প্রয়োজনীয় রসদের কেনাকাটি হল ভালোই। তারপর কল্পা।

কল্পা শহরের আরো ওপরে হিমাচলী সরকারের হোটেল কিন্নর কৈলাশ। পাহাড়ের ধাপে ধাপে আপেল বাগানের গা ঘেঁষে কটেজ গুলো ছবির মতো ফুটে আছে। এই গ্যালারি থেকে নাকি ভাগ্যে থাকলে সকালের আলোয় দেখা মেলে কিন্নর কৈলাশ শৃঙ্গ-শ্রেণীর, এখন মধ্যদিনের ঝলসানো ঔজ্জ্বল্যে যিনি আড়ালে। হোটেল ভারী সুন্দর, হোটেল কর্মী দের আতিথেয়তা আরো সুন্দর, আর সবচেয়ে সুন্দর স্নান সেরে ভিজে চুল এলিয়ে দিয়ে দুপুরের রোদে পিঠ পেতে পাহাড়ি হাওয়া আর আধপাকা আপেলের গন্ধ নেবার আমেজ। এবারে আমাদের থাকা মোটে একদিনের, কিন্তু কল্পা আর্জি জানিয়ে রাখলো আবার আসার, অনেকদিনের জন্যে।

বিকেলে দেখতে বেরোনো রোঘী গ্রাম, সুইসাইড পয়েন্ট, আর চিনে নেয়া কল্পার অন্দর। সবুজে সবুজ কল্পার পাহাড় মোড় ঘুরতেই মেটে-রং, পাথুরে। অতলান্ত খাদের বুকে ঝুলে থাকা সুইসাইড পয়েন্ট এর পাথরে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালেই দিব্বি টের পাওয়া যায় বেঁচে থাকতে কত ভালোবাসি। সেই কাঁপন নিয়েই এলাম  রোঘী গ্রামে। ছোট্ট গ্রাম-- আপেল বাগানের ভিতর দিয়ে রাস্তা; পায়ে পায়ে হেঁটে দেখে নেয়া যায় সমবায় অফিস, পোস্ট অফিস, গ্রামের মন্দিরের চুড়ো, আর আলাপ জমিয়ে নেয়া যায় স্কুল-ফেরত একদল ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে। তাদের দেখাদেখি পথের ধুলো থেকে কুড়িয়ে মুখে দেয়া টুসটুসে পাকা এপ্রিকট, মিষ্টি রসে জারিয়ে ওঠে কল্পার বিকেল। এখানে বাঙালী পর্যটকের কদর ভারী, এপ্রিকট কুড়ুনি মেয়েটি দেখেই চিনে নেয় আমাদের কলকাতার দল বলে। পাহাড়ে আগেও দেখেছি এমনটা, বাঙালী বলে বেশ একটু গর্ব ই হয়েছে সব সময়। 

ফিরে আবার চিন্নি গ্রাম, যার ই অধুনা নাম কল্পা। পাশাপাশি মন্দির আর মনাস্ট্রি, জোড়া দুই আঙ্গনে অমলিন হাসি আর খেলায়  উচ্ছল একদল মেয়ে। তাদের সঙ্গে আলাপ, খেলায় যখন বেশ মেতে, তখন ই হঠাৎ খেয়াল পড়লো এদের বাসস্থান: পাশের অনাথ-আশ্রম টি। অনেক পেয়েও আরো না পাওয়ার দুঃখে দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী করে তোলা আমাদের জীবন কে মুহূর্তে ব্যঙ্গ করে গেল এদের এই বিকেলের বন্ধু-সাহচর্য টুকু পেয়েই অনাবিল আনন্দে ভাস্বর মুখগুলো। ভারী পরিপূর্ণ একটা বিকেলের শেষে অস্ত গেলো কল্পার উজ্জ্বল সূর্য। 

কল্পা কে সেদিন চিনলাম তার মনের উষ্ণতায়, তবু ঘুমোতে যাবার সময় ছিলই বুক-দুরুদুরু : পরের দিন যদি দেখা না পাই কিন্নর কৈলাশের? আমি বার পাঁচেক দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি মোটে একবার, তাই দুষ্প্রাপ্য দর্শন না পাবার ভয়টাই বেশি ছিল। 

পরদিন অ্যালার্ম এর ও আগে ঘুম ভেঙে গেছে, বাইরে তখন চরাচর ব্যেপে মেঘ, আলোর ফুলকি ফোটেনি তখনো। আনমনে আবার ঘুমিয়ে পড়বো  কিনা ভাবছি, তখন ই হঠাৎ একফালি আলো এসে পড়লো আকাশের একটি প্রান্তে, মেঘের বুক চিরে জেগে উঠলো পাথর-বরফে মেশানো একটি অবয়ব। পাঁশুটে ভোর তখনো চারপাশে, শিশিরের শীত তখনো ঘাস ছুঁয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার খালি পা, তখনো জেগে ওঠেনি পাহাড়। শুধু এক সবজেটে পাহাড়ি thrush আমার সামনের আপেলগাছটায় এসে বসলো, ছোট ছোট তীক্ষ্ণ শীষে সুর ছড়িয়ে দিতে লাগলো পাহাড় উপত্যকার বুক ভাসিয়ে ঠিক যেন অবন ঠাকুরের গল্পের সেই কুঁকড়ো র মত-- আর এক এক পরতে একটু একটু করে সরে যেতে লাগল মেঘের আস্তর, আকাশের বিশাল ক্যানভাসে একটু একটু করে জেগে উঠতে লাগল দিগন্ত জোড়া কিন্নর কৈলাশের শ্রেণী। সহযাত্রীদের ডেকে দেখাতে গেলাম, তারা একবার দেখেই তলিয়ে গেলো ঘুমের রাজ্যে; ক্যামেরায় চোখ রাখতে গেলাম, মেঘ-কুয়াশার বেরং পেরিয়ে ছবিতে ধরা দিলো না এই জাগরণ-- এ দৈব মুহূর্ত যেন আমার, শুধু আমার জন্যে ফুটে উঠলো বিশ্বলোক জুড়ে। কি এক অহৈতুকী কৃপায় এক লহমায় পুণ্য হয়ে উঠল আমার অস্তিত্ব। আমার দুদিনের পথ চলা হঠাৎ ই সময়ের সীমা ছাড়িয়ে উপচে গেল, লুপ্ত করে দিল স্বপ্ন আর বাস্তবের তীর। আর কূলপ্লাবী হৃদয় নিয়ে ভারী অযোগ্য ভারী নগণ্য  আমি, আমার ছোট জগৎ ছোট স্বপ্ন ছোট সংসার নিয়ে ছোটত্বের সাধনায় ভুলে থাকা আমি, শুধু তাকিয়ে রইলাম এ  বিশাল, বিপুল বিশ্বরূপের পানে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...