রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

এমন কেন সত্যি হয়না আহা: পর্ব ২: কৌন্তেয় কর্ণ

(ব্যর্থতা বহু-স্তরী। আমাদের চেনা গল্প, চেনা ইতিহাস, চেনা দুনিয়া জুড়ে অনেক ব্যর্থতার কাহিনী আছে, যারা কাঁদায়, ভাবায়। সেই সব কাহিনী কে নিয়েই এই সিরিজ~ ঠিক কোনখানে ব্যর্থতা আর সফলতা এক হয়ে যায়, সব ব্যর্থতা ই বেদনার কিনা, আর কোন কাহিনীতে ব্যর্থতা টুকু সরিয়ে নিলে সে গল্প আরো ধুসর, আরো নির্মম হয়ে ওঠে, তার ই সন্ধানে এই লেখা। আজকের চরিত্র: কর্ণ।)

সভাকক্ষের বিশাল গবাক্ষপথে আসিয়া পড়িতেছে সন্ধ্যা-সবিতার বিলীয়মান দুই একটি রশ্মিচ্ছটা। সম্মুখের প্রত্যাশী জনতার দাবি ফেলিয়া আজ আমার সান্ধ্যান্হিক সারা হয় নাই পুণ্য জাহ্নবীর তীরে। আমি, কর্ণ। হস্তিনাপুরাধিপ, পান্ডব-অগ্রজ কর্ণ। দেখ, ললাটে কেমন জ্বল্জ্বলাট বংশগরিমার তিলক, মাথায় কেমন স্বর্ণমন্ডিত রাজমুকুট, বাহুতে কেমন অমিত-বল এর সংহত রূপ-- আমি উঠিয়া আসিয়াছি, রিক্ততার, বঞ্চনার, কুল-শীল-মান-হীনতার অন্ধকার গর্ভ হতে। আমি, কর্ণ। বামপার্শ্বে ব্যজনরত ওই ধীমান যুধিষ্ঠির, ডাহিনে  অলস অর্ধশযানে ওই বহুবলী ভীম, সম্মুখে উপবিষ্ট ওই সুপুরুষ মদ্র ভ্রাতৃদ্বয়, আর পশ্চাতে রাজ্ছত্রধারী ওই গান্ডীবধারী অর্জুনের জ্যেষ্ঠ, আমি কৌন্তেয় কর্ণ।
আমি কর্ণ, তবু সেই শালপ্রাংশু-মহাভুজ, রথিশ্রেষ্ঠ, দানবীর কর্ণ নহি, যাহাকে তোমরা চিনিতে। যদিও এখনো আমার ক্ষাত্রতেজ উদ্দীপ্ত দুই বাহুতে, যদিও এখনো নির্ভুল আমার শর-যোজন, যদিও এখনো প্রার্থীর বিফলতা দেখিতে হয় নাই আমায়, তবু, আমি সে কর্ণ নহি আর। আমার সে প্রশস্ত দাম্ভিক ললাট আজ মেঘাছন্ন বন্ধুদ্রোহের গ্লানিতে, আমার সে আত্মশুদ্ধির গৌরব~ যা কবচ-কুন্দলের চেয়েও সোচ্চারে আমার পিতৃ-পরিচয় ঘোষণা করিত, আজ তা পরাজয়ের অগৌরবে, অধমর্নের লজ্জায় লিপ্ত। সে কর্ণের মৃত্যু ঘটেছে কুরুক্ষেত্রের রণ-ভীষণ সেই মুহূর্তে, যখন সহসা মেদিনিবিদ্ধ আমার রথচক্র, সহসা বিস্মৃতির অভিশাপ আমার অজেয় অস্ত্র-সম্ভারে, যখন অর্জুনের উদ্যত বাণ ই এক অন্তিম পরম সত্যের মত স্থির, নিশ্চিত। তাহার পর পার্থ-সারথির উচ্চকিত নিষেধ, অর্জুনের কাছে আমার কৌন্তেয়-পরিচয়-দান, আর বিস্মিত, স্তব্ধ সব্যসাচীর অস্ত্র-সংবরণ যে কর্ণ কে নবজীবন দান করিল, সে কর্ণ অধিরথ-সূতপুত্র নহে, অজ্ঞাত-শীল বীর মাত্র নহে, আপন চরিত্রবলে আপনি সুন্দর সেই কর্ণ নহে। আমার প্রানের মূল্যে আমি তখন পান্ডব-ঋণে ঋণী, এক লহমায় ছাড়িতে হইল মিত্রশ্রেষ্ঠ সু-যোধনের আলিঙ্গন, ছাড়িতে হইল অর্জুনের সহিত চির-প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ছাড়িতে হইল বীরোচিত গৌরবের মৃত্যুর এষণা। সেই আশ্চর্য মুহূর্তে এক ই সঙ্গে আমি লভিলাম আমার আজন্ম-কাঙ্খিত বংশ-গৌরব, আর হারাইলাম আমার আজন্ম-সাধিত বীরধর্ম। আজ আমি এক পরাজিত রাজা, এক রাজমুকুট-ধারী ক্রীতদাস মাত্র।
বিশ্বের স্পৃহনীয়তম সিংহাসনে বসিয়া আছি, অথচ এমন নি:স্ব এমন কাঙ্গাল আর নাই। রাজপদ থাকিতেও আমি মর্যাদা-হীন~ আমার শিক্ষার ন্যূনতা, আচরণের অনুপযোগিতা আমায় প্রতিমুহূর্তে ব্যঙ্গ করিয়া চলে। পঞ্চ-ভ্রাতা থাকিতেও আমি আত্মীয়-হীন~ অসীম ঋণের বাধা, অসীম দয়ার বন্ধন তাহাদের সঙ্গে রচিয়াছে দুর্লঙ্ঘ ব্যবধান। অতুল শৌর্য থাকিতেও আমি হতবল~ আমার চির-প্রতিদ্বন্দ্বী সব্যসাচীর দয়া অপহরণ করিয়াছে আমার বীরসম্মান। বহু-প্রার্থিতা দ্রুপদ-নন্দিনীর সান্নিধ্য থাকিতেও আমি একা~ তাহার অতুল ঘৃণা পার হইয়া তাহাকে লভিব এমন সাধ্য কোথায়। আজন্ম-বন্চিত মাতৃপরিচয় মিলিতেও স্নেহের আশ্রয় মেলে নাই আমার~ জানিয়াছি, স্নেহের সে দাবি বহুকাল তামাদি হইয়া গিয়াছে, তাহাকে কোনো যত্নেই পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নহে। এখন শুধু একাকিত্বের, পরাজয়ের এ দারুণ  গ্লানি বহিয়া ব্যর্থ কর্ণের এই দিন-যাপন, উদয় হইতে অস্তাচলের পানে, গৌরবের মধ্যান্হ হইতে পরাজয়ের সায়ম-এর পানে, অস্ত্র-পরীক্ষার নব-উদয় হইতে মহাপ্রস্থানের অন্তিমের পানে।

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...