বৃহস্পতিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১২

বাতাস-বাড়ি

এই যে এখন সাদা চৌকোমত-লাল টালির চাল দেওয়া বাড়িতে আমি থাকি, ঠিকানা বলতেই সড়াত করে বেরিয়ে আসে "ফোর-টু-ওয়ান ..", তা বলে এটা কিন্তু আমার ঠিকানা নয় মোটেই। আমার ঠিকানা রয়ে গেছে সেই ক-বে ছেড়ে আসা দুই-এর-এক ষষ্ঠীতলা রোড এর পুরনো ভাঙ্গা বাড়ি টায়, যেখানে আটকা পড়ে আছে আমার শৈশব। 

কেমন ছিল সেই ঠিকানা আমার? সরু একটা দরজা দিয়ে ঢুকেই মস্ত বড় উঠোন, শাওলার আক্রমনে পিছল--অনেকটা "গল্প হলেও সত্যি" র সেই বাড়িটার মত। উঠোনের চারপাশে একগাদা ঘর, রোজকার হেসেল এর পাশে আবার বাতিল হয়ে যাওয়া উনুন-অলা হেসেল, অন্ধকার কি জানি কিসের আরো কটা ঘর, যেগুলো আমাকে খাওয়ানোর সময় "ভুতের ঘর" হিসেবে কাজে আসত।দোতলার বাইরের দিকে ছিল টানা খোলা বারান্দা, মোটে দোতলা হলেও চারপাশে তখন তো আর বহুতল ছিল না তত; আর পাশে ছিল একটা ছোট কারখানা মত--তাই গরমের সন্ধ্যে সেই বারান্দায় দখিনা হাওয়ার বান ডাকত, বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে জমায়েত বসত গান আর আড্ডার। চৈত্র সংক্রান্তি তে এই কারখানা থেকে আবার যাত্রার আয়োজন হত, আমরা বারান্দায় বসেই দিব্বি দেখে নিতাম সেই যাত্রা--অবশ্য চাঁদ সদাগর এর ওপর রাগ করে মনসা কি বললেন সেটা দেখার আগেই আমি ঘুমে কাদা, কিন্তু ওই যে সন্ধ্যে থেকে ওদের হাজাক লাগানো, একপাশে ত্রিপল টাঙিয়ে মেক-আপ রুম, সেসব একটা আলাদা রোমাঞ্চ নিয়ে আস্ত। মনসার বেগনি রঙের শাড়ী দেখে প্রত্যেক বার ই কেন জানি না, পিসি কে চুপিচুপি একবার আমায় যে শাড়ী টা "বড় হলেই দিয়ে দেবে" বলেছে সেটা সম্মন্ধে নিশ্চিত হয়ে নিতাম।এখন পিসি ও নেই, সেই শাড়ী ও পোকা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু সেই চৈত্র সন্ধ্যার প্রতিশ্রুতি এখনো তার গায়ে মাখানো যে, তাই ফেলে দিতে পারিনি ...

আমি ছোটবেলায় খুব হাদা মেয়ে ছিলুম, (এখনো আছি হয়ত যাকগে জাহির করে কাজ নেই) যে যা বলত সব ই অকুল বিশ্বাসে মেনে নিতুম। আমায় খাওয়ানোর সময় আমি বেগুন ভাজা খাবার বায়না ধরলে আমায় বুঝিয়ে দেওয়া হত যে পাচিলের ওপর সদ্য গজানো আমগাছ টায় বেগুন ফলবে তখন আমাকে নির্ঘাত বেগুন ভাজা করে দেওয়া হবে, তিন সত্যি--আর আমিও অমনি বিশ্বাস করে খেয়ে নিতাম। ওই বাড়িটার দোতলায় ঠাকুমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখতাম একটা সাদা কালো বেড়াল, সে রোজ সূর্য ডোবার সময় এসে বসে থাকত চুপ করে, তাই দেখে একদিন বলেছি যে বেড়াল টা ভক্ত বেড়াল, সূর্য নমস্কার করতে আসে--তা সবার কি হাসি! এই রকম হাজার বোকামি ছড়িয়ে আছে ওই বাড়িটার আনাচে কানাচে, যারা আমাকে একটু একটু করে শিখিয়েছে যে সব কথা ভাগ করে নিতে নেই। কিছু কথা থাকে এক্কেবারে নিজের।

দোতলার সিড়ি বেয়ে উঠতে গেলেই আমার বৈকালিক খেলার জায়গা--আমি আর আমার জ্যাঠতুত দুই বোন অদ্ভূত সব খেলা খেলতাম ওই ধাপটায় বসে--কখনো বাস এর কনডাকটার, কখনো কাজের মাসি, এইসব সেজে খেলা। আর তার ওপরে উঠলে--ছাদ। আমার মুক্তির জায়গা, আমার ছোটবেলার অনেকখানি জুড়ে সে। একপাশের চিলেকোঠায় ঠাকুর-ঘর, তাতে বম্মা সকাল থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে মন্ত্র পরে চলত, আর স্নান সেরে মা পড়তে বসানোর আগে অবধি আমার ছুটি।আপন মনে ঘুরে বেড়ানোর ছুটি, বাধা-বন্ধ-হীন নিজেকে নিজের মত পাওয়া--কখনো আপন মনে কথা কইতাম, নাটকের সব চরিত্র নিজেই হয়ে অভিনয় করে ফেলতাম, সুকুমার রায় এর গল্প গুলো সাজিয়ে বসতাম সেই ছাদ এ। ছাত এর পাচিল ঘেষে একটা অশ্বত্থ চারা হয়েছিল, বাবারা লোক ডাকিয়ে মাঝে মাঝেই কেটে দিত, কিন্তু শিকর টা রয়ে যেত তার, আবার একদিন ইটের কঙ্কাল থেকে উঁকি দিত--আমি উত্সাহ দিতাম এই গাছটাকে খুব, ভাঙ্গা ইটের টুকরো দিয়ে মাপতাম কতখানি বাড়ল গাছটা।তার ডালে একবার বাসা করেছিল কাকে, সেই ছোট্ট ছোট্ট ছানা গুলো লাল লাল মুখ হা করে সারাদিন কি চেচান চেচাত যে, সে এক কান্ড! দুপুর গড়ালে বম্মা বেরোবে পুজো সেরে, আমার বরাদ্দ নকুলদানা নিতে না নিতেই মা এসে পড়বে, আর অমনি আমার ছুটি ফুরিয়ে গিয়ে পড়াশুনোর শুরু ...

পাচ বছর বয়েসেই সেই বাড়িটা ছেড়ে চলে এসেছি, কিন্তু কি সম্মোহন ই না ছিল সেই নোনাধরা পুরনো বাড়িটায়, মনের মধ্যে ছবির মত গেথে আছে দিন গুলো।এখন মস্ত বড়লোক এক মারওয়ারী থাকেন ওই বাড়ি খানায়, সামনে বুগেনভিলিয়ার লতা, বাড়িটা এখন সত্যি ভালো আছে। আমিও ভালো আছি, কার্পেট পাতা বাতানুকুল ঘরের এই বাড়ি টাতে--কিন্তু ওই যে বললাম শিকড়--কে জানে কত গভীরে চারিয়ে গেছে সে, যতবার কেটে ফেলতে চাই আবার সহস্রগুনে ফিরে আসে ...






সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১২

বিদায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

মহানবমীর সুপ্রভাতে কলকাতা যখন জেগে উঠছে আরো একটা সুন্দর পুজোর দিনে, আমার মতন প্রবাসী কিছু মন যখন আকুল আঁখি পেতে জেগে আছে ফেসবুকের পাতায় কলকাতার পুজোর নতুন "updates" পেতে, তখন ই হঠাত এলো খবর টা: চলে গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। হঠাত যেন শেষ হয়ে গেল একটা যুগ--আমার বড় হয়ে ওঠার সেই সময় টা। সেই লেখক, যার কাকাবাবু পড়ে শুরু হত পুজো গুলো, যার প্রথম আলো সেই সময় বারবার পড়েও পুরনো হয়না, যার পূর্ব-পশ্চিম প্রথম চিনিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তমাখা অধ্যায়, যার এক একটা কবিতার পংক্তিতে আটকা থেকেছে আমার কত না গুনগুনিয়ে-ওঠা-ভর--তিনি আর নেই। অপ্রত্যাশিত খবর টায় যেন কি এক ধুসর ম্লানিমা ছিল, মলিন হয়ে গেল পুজো-পুজো গন্ধ টা।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না থাকলে কেমন হত আমার বড় হয়ে ওঠা? প্রথম পড়তে শিখেই সন্তু র সঙ্গে সঙ্গে শিখে নেওয়া হত না কনিষ্ক র ইতিহাস বা হায়রগ্লিফিচ্স এর মানে; ক্লাস নাইন এ বই এর ফাকে রেখে ডুব দেওয়া হত না নীললোহিতের দিক-শূন্যপুরের সন্ধানে; জানা ই হত না অদ্ভূত যে মন-খারাপ গুলো ছেয়ে যেত হঠাত হঠাত, তাদের মানে। এখনো মনে আছে সেই সময় প্রথম পড়ার সেই দিনগুলো--একেবারে বাস্তব-জ্ঞান শুন্য হয়ে সেই কবেকার কলকাতা শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর অনুভব--নবজাগরণের কলকাতা; যা ভারতের ইতিহাসে এতটা তাত্পর্য্য পূর্ণ একটা অধ্যায়, আর কেউ কি এমন করে ধরে রাখতে পেরেছেন কল্পনা-ইতিহাসের মিশেলে এমন সুন্দর করে? সুনীল গান্গুলি র হাত ধরে প্রথম পাড়ি  দেওয়া "আধুনিক কবিতা" নামক ভীতিপ্রদ রাজ্যে--রবীন্দ্র-ছায়া পেরিয়ে অন্য কবিতার গুণগ্রাহী হওয়া টা আমার কাছে বেশ কঠিন ছিল, আছেও--তবে সুনীল এর ঝরঝরে অনায়াস পংক্তি গুলি অর্থ না বুঝেও ভালো লেগে যেত, মন ছুয়ে যেত। তারপর পরলাম পূর্ব-পশ্চিম--আরেক মহা-মূল্যবান রচনা, আমার এপার বাংলার দৃষ্টি তে প্রথম দেখতে পেলাম ওপারের ছবি, প্রথম জানা মুক্তি-যুদ্ধের মানে। এ ছাড়া ভ্রমন-কাহিনী তাই বা এমন সরস এমন সুন্দর করে কে লিখতে পেরেছে, এ দেশে আসার আগে এ দেশ কে অল্প-সল্প চিনলাম ও সেই সব ভ্রমন-কাহিনী পড়েই (অবশ্য সে চেনা বিশেষ কাজে আসেনি, এক ভবঘুরে কবি র দৃষ্টি তে সত্তরের আমেরিকা আর এক ভালোমানুষ ছাত্রীর চোখে আজকের এ দেশ একেবারেই এক রকম নয়)।   
আর ছোট গল্প। সত্যজিত এর পর বাংলা ছোটগল্প আর কারো হাতেই এত সার্থকতা পায়নি। ছোটদের বড় দের সব্বার জন্যে রয়েছে সেই ভান্ডার; নানান স্বাদের নানান বিষয়ের, ধরা পড়ে তার জানার পরিধি আর লেখার বিস্তার, জানান দেয় তার বৈচিত্র।
স্বীকৃতি পেয়েছেন কিছু, অনেক নিন্দা আর বদনাম কুরনোর পাশাপাশি পেয়েছেন অশেষ ভালবাসা ও। পাওনা ছিল আরো অনেক কিছুই, হয়ত বাঙালি বলেই যে সম্মান অধরা থেকে গেল। হয়ত শেষ স্বীকৃতি দিয়ে উঠতে পারবে না কৃপণ বাঙালি। তবু আমার মত আরো অনেকের ই মনে চিরদিনের হয়ে থেকে যাবেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী সুনীল, আর থেকে যাবে আমার কাকাবাবু সমগ্রের পাতায় তার হাতের লেখায় আমার নাম টা। মৃত্যুর কাছে কাকাবাবু হেরে গেলেন বটে, কিন্তু সব হার ই তো শেষ কথা নয় ...


রবিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১২

"আমার রাত পোহালো শারদ-প্রাতে"

আজ মহালয়া। পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের শুভ-সূচনা। আর কয়েক ঘন্টা পরেই আমার চেনা শহর জেগে উঠবে আধ-ভোরের শুভ সুন্দর মুহুর্তে, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত চন্ডিপাঠ আর সুপ্রীতি ঘোষের মধু-কন্ঠে "বাজলো তোমার আলোর বেনু"র সুরে সুরে দুলে উঠবে এক পবিত্র ভোর। এক মুহুর্তে মিথ্যে হয়ে যাবে প্রতি দিনের ক্লেদ-ক্লান্ত জীবন, মূল্য-বৃদ্ধির সঘন ঘনঘটা, এফ-ডি-আই এর সুফল-কুফল সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কচকচি--এক মুহুর্তে আমার শহর সব এক ঘেয়েমি ঝেড়ে ফেলে হয়ে উঠবে সব-পেয়েছির-দেশ। আজ যে মহালয়া, দেবীপক্ষের শুভ-সূচনা। 

বাইরের রৌদ্র-ক্লান্ত অক্টোবর কে পাশে রেখে ক্রমশ হারিয়ে যাই সেই অলীক মহালয়ার ভোরে। চারিদিকের বাস্তব কেমন মিলিয়ে যায় আমার অস্তিত্ব থেকে, স্মৃতির সমুদ্র সেচে খুঁজে পাওয়া মহালয়া র চলে উদযাপন। সদ্য-ঘুম ভাঙ্গা চোখে বারান্দায় দাড়িয়ে সেই পূব-আকাশে একটু একটু করে রঙের ছোয়া লাগার মুহূর্ত টা, চারপাশ থেকে প্রতিদ্বনিত "অহং রুদ্রেভি বসুভিশচরাম্যাহাং", তারপর সাদা ধুতি পরে বাবার সেই তর্পনে যাওয়া আর আমাদের টি ভি খুলে অত্যন্ত হাস্যকর যাত্রা-পালা ধাচের "মহিষাসুরমর্দিনী" দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া -- ফিরে আসে, ঘিরে থাকে। তাই চারিদিকে শরতের বিন্দু মাত্র চিন্হ খুঁজে না পেয়েও মনের আকাশে চলে পেজা তুলো মেঘের আনাগোনা, শিউলি তলা ভরে ওঠে সাদা-কমলার টাটকা আল্পনায়। অনলাইন পূজাবার্ষিকী তে কাকাবাবুর জঘন্য গল্প পরেও সেদিনের সেই হাতে আনন্দমেলা পেয়েই অপ্রকাশিত সত্যজিত আর শৈলেন ঘোষের উপন্যাস গোগ্রাসে পরে ফেলার উত্তেজনা সমান সত্যি থেকে যায়। মনে মনে ফিরে যাই সেই পরীক্ষা-শেষের বিকেলে মায়ের হাত ধরে কুমোরটুলি আর বাগবাজার ঘাটে--সেই তার পরের দু তিন দিনের লাগাতার আয়োজনের শেষে পঞ্চমীতে স্কুলে "আগমনী" অনুষ্ঠানে--সেই চতুর্থীর রাতে ঢাকের বোলে পাড়ার ঠাকুর আসার উত্সাহে, সেই বাড়ির সামনে এক গুচ্ছ টুনির আলোয় এক বছরের অপেক্ষার শেষে হঠাত এসে পড়া দুর্গাপুজোর আনন্দে। জানি না কবে আবার কলকাতার দূর্গা পুজো মেখে নিতে পারব সারা গায়ে, কবে আবার ফিরবে সেই বোনের সঙ্গে উত্তর-মধ্য কলকাতা চষে বেড়ানো আর পেটপুরে ফুচকা-ঘুগনি-আইসক্রীম এর দুপুর--হয়ত ফেরার দিন যখন আসবে অনেক অনেক পাল্টে যাবে জীবনের রং, অনেক বদলে যাবে সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা--শুধু জানি সেদিন ও বাগবাজার মন্ডপে দেখা পাব চিরন্তনী সেই মাতৃ-মূর্তির, সেদিন ও মহালয়ার ভোরে ঘুম ভাঙ্গাবে "রূপং দেহি জয়ং দেহি যশ দেহি"র চিরন্তন প্রার্থনা। 

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...