শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

"আমার ছুটি নীল আকাশে.."

ছোটবেলায় সবার ই বোধয় একটা খুব প্রিয় শব্দ থাকে "ছুটি"| ক্লাসরুম এ একঘেয়ে পড়াশুনোর ফাকে তৃষিত মন তা বসে থাকত কখন বৃন্দাবন-দার ঘন্টা বেয়ে ছুটি ঝরে পড়বে দিনের বুকে--পুজোর আগে আগে হাফ-য়িয়ারলি এসে যাবার সময় থেকেই চলত পুরোদমে পুজোর ছুটির দিন গোনা, আর রোদের তাপ বাড়তে বাড়তে যখন ই বাড়ি ফিরে ডাবের জল না পেলে চলত না, তখন  ই এসে  যেত গরমের ছুটির সময় | ছোটবেলা টা ছুটি ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকত | ছুটি মানেই সেই বেলা করে ওঠা, পড়তে বসার কোনো তাড়া ই নেই, অলস একগুচ্ছ দিন ধীর লয়ে কাটিয়ে দেওয়া...ছুটি মানেই দুপুর বেলাটার জন্যে অপেক্ষা করে থাকা কখন "ছুটি-ছুটি" শুরু হবে--সেই মিনিট দশ মাজিক মিনিট দশ গান-গল্প আর তারপর কিছুটা সিনেমা | প্রথম "জয় বাবা ফেলুনাথ" ছুটি-ছুটি তেই দেখি, মনে আছে..তখন সিনেমা জিনিস তাও এমন চট করে লাপটপ খুলেই দেখে নেওয়া যেত না, তাই সেটাও একটা আকর্ষণ ছিল বৈকি | আর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে গ্রীষ্মের দুপুরে পর্দা-টানা আলো-আধার ঘর, খাতে উপুড় হয়ে শুয়ে কোনো গল্পের বই এর মধ্যে ডুব দিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া...আমি বরাবর ই একটু ঘরকুনো, তাই ছুটির সব-সেরা আনন্দ ছিল এই বই নিয়ে সারাদিন এর সফরেই...এখনো শ্রেষ্ঠ সময় কাটানো বললেই স্বর্গের মত সেই আবছায়া ঘর, মাঝে মাঝে মায়ের দিয়ে যাওয়া আমের সরবত এ চুমুক আর "hunchback of notre-dam" এর পৃষ্ঠা গুলোই মনে পড়ে...অবশ্য এই অলস মধ্যাহ্ন গুলোর দাম করায়-গন্ডায় চুকিয়ে দিতে হত স্কুল খোলার আগে আগে অজস্র ছুটির কাজের চাপ সামলাতে সামলাতে--সে তখন দু তিন দিনের মধ্যে ২০ পাতা হাতের লেখা, ৫ দিনের দিনলিপি আর শ-দুএক অঙ্ক নামানোর ঝক্কি! তবু, সব মিলিয়েও সে দুপুরগুলো র জন্যে এটুকু ঝামেলা নেওয়া ই যায়, তাইনা?
তখন ঠাকুমার ছিল অসুখ, তাই ছুটি মানে খুব বড় বড় বেড়াতে যাওয়া হয়ে উঠত না, হয়ত মাঝে মাঝে পুরি, কি দীঘা, কি বীরভুম, এইরকম...মাধ্যমিকের পরে ছুটি তে যোগ হলো সেই মাত্রা টাও; ছুটি আসার অনেক আগে থেকে সেই রবি ঠাকুরের কবিতাটার মতন ই কথায় যাওয়া যায় এর plan শুরু হয়ে যেত, তারপর ছুটি পড়তে না পড়তে শুরু গোছগাছ, উদ্যোগ-আয়োজন...তখন ছুটি মানে প্রথম ভাগে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ, গোছগাছ প্রস্তুতি, আর দ্বিতীয় ভাগে বেড়িয়ে ফিরে আসার পরের ক্লান্তি, মন-খারাপ,বেড়ানোর আড্ডায় মশগুল কিছু সন্ধ্যেবেলা...সেই ছুটি গুলো কোনটা সিমলা-মানালি, কোনটা ভাইজাগ-আরাকু, কোনটা শ্রীনগর-পাহেল্গাম বা গান্গ্তক-পেলিং বলেই চিন্হিত হয়ে আছে; কোনো ছুটির কথা মনে পড়লেই মন-জোড়া পেলিং এর মেঘলা সকাল আর কুয়াশা মাখা ছান্গু, কোনো ছুটির গায়ে এখনো লেগে আছে ডাল লেকের জলের ছিটে--আর সঙ্গে সেই একটু-একটু করে বড় হবার আধ-চেনা অনুভূতি...
ছুটির মানে বদলে গেল দিল্লি যাওয়ার পর; সঙ্গে বদলালো সময় টাও! এই প্রথম দেখি পুজোর ছুটি উধাও হয়ে গেল, বদলে এলো মাস-জোড়া শীতের ছুটি! আমি অবশ্য কোনো দিকেই আপোষ এর পাত্রী নই, শীতের ছুটি টা যেমন খুশি হয়েই নিয়েছিলাম হাত পেতে, তেমনি পুজোর সময় ও এক সপ্তার অঘোষিত ছুটি করে নিতে আমার অসুবিধে হত না | গোল্লায় যাক পড়াশুনো-ক্লাস; কলকাতায় যখন মন্ডপে মন্ডপে ঢাকের তালে দেবী-বরণ, আমি তখন বই এর পাতায় মুখ গুঁজে থাকব?--কাভি নেহি! সুতরাং এক নম্বর: পুজোর ছুটি, এক সপ্তার; মানেই বাড়ি যাওয়া আর গত সপ্তা শহর জুড়ে টহল...দু- নম্বর, নতুন পাওয়া শীতের ছুটি, যার মানে হলো সেমেস্টার শেষ করে আবার রাজধানী,কলকাতার নরম শীতের রোদ্দুরে কমলালেবু আর চুল-শুকনোর নাম করে ছাদে পাড়া-পর্যবেক্ষণ আর পিকনিক আর ক্রিসমাস এর নাহুম! তবে সবচেয়ে বড় ছুটি টার পুরোটা আর ছুটি করে পাওয়া হয়ে ওঠেনি, একভাগ চলেই গেছিল বিচ্ছিরি ইংরেজি শব্দে র সাধনায় (সাধে বলে,"শব্দ-ব্রহ্ম"!) বাকিটুকু নিয়ে অবশ্য সেই ছোটবেলার মত অলস দিন...
বিদেশে এসে দেখি ছুটি অনেক এবং অনেক প্রকার ও বটে..সপ্তায় সপ্তায় এরা সপ্তাহ শেষ হবার আনন্দেই ছুটি উদযাপন করে থাকে, তা ছাড়া থাকে ক্লাস না থাকলে অঘোষিত ছুটি, বৃহস্পতি-শুক্র ছুটি থাকলে বুধবার টাও জুড়ে নিয়ে তৈরী করা "লম্বা সপ্তাহান্তের" ছুটি, আর এমনিতে তো আছে ই দেড়মাস শীতের আর তিন মাস গরমের ছুটি! কিন্তু এই প্রথম বুঝলাম ছুটির আসল আনন্দ কখনই একা একা উপভোগ করা যায় না, হাজার অলস সময় ও শুধু বই নিয়ে কাটানো যায়না, অনেক সময় একা থাকার সময় কাজ ও যেন কাঙ্খিত সহচর হয়ে ওঠে ! বুঝে পাই না ছুটির মানে টা হঠাত এরকম পাল্টে গেল কিকরে, নাকি আমি ই কখন পাল্টে গেছি? অনেক?






বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

মেঘলা মন

আবার সকাল থেকে আকাশ ঘিরে কালো মেঘ, বৃষ্টি এলো চরাচর অন্ধকার করে; আর অমনি আমার মনের ভিতর এতদিনের ঘুমিয়ে থাকা  নিজেকে  নিজের  মতন  করে কিছুক্ষণ  পাবার  ইচ্ছেটা  আবার জেগে উঠলো ...to-do list এর কড়া শাসন আর কর্তব্যের চোখ-রাঙ্গানি র বিরুধ্যে বিপ্লব করে উঠলো আমার সমস্ত সত্তা...আর অনেক অনেক দিন পর চলে এলাম পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে ভাগ করে নেওয়ার এই আঙ্গিনায়... 
ছোটবেলায় "আমার প্রিয় ঋতু " লিখতে দিলে মাঝে মাঝে শরত মাঝে মাঝে গ্রীষ্ম লিখতাম (প্রথম টা যে কোনো বাঙালি শিশুর একটা অনিবার্য পছন্দ, আর দ্বিতীয় তে কবিত্ব বা "অন্যরকম" হবার প্রেরণা যতটা না আছে তার চেয়ে বেশি আছে আম-কাঠালের তীব্র আকর্ষণ,স্বীকার করতে লজ্জা নেই :P )...কিন্তু কলকাতা ছেড়ে দিল্লি যাবার পর বুঝলাম নিজেকে ই চিনতাম না এদ্দিন, শরত না, গ্রীষ্ম না, এমনকি কোনদিন কলকাতায় চোখে না দেখা "হেমন্ত" ও না, আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু হচ্ছে বর্ষা...কলকাতার থেকে চরিত্র আলাদা হলেও গ্রীষ্ম সব জায়গাতেই আছে (অনেক জায়গায় নেই ও, কিন্তু সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তেমন জায়গায় কক্ষনো থাকিনি), শরতের মত  পেজা  তুলো-মেঘ আমি অস্টিন এও কতবার দেখেছি,সঙ্গে নির্ভেজাল কাশফুল! কিন্তু কলকাতার মতন অমন বর্ষা আর দেখিনি....অমন সারাদিন ঝিরঝির ঝমঝম একটানা অবিরল, অমন ণীল মেঘের স্তুপ আর তার ছায়ায় বিষন্ন গোটা শহর,অমন যখন তখন এক লাফে এসে শহরের মালিকানা ছিনিয়ে নেওয়া দুরন্ত বর্ষা....আর  কোনো ঋতুই কি পারে আমার শহরের চরিত্র এক নিমেষে এত টা বদলে দিতে? আর কোনো ঋতু ই কি আছে যার জন্যে এত আগ্রহ নিয়ে পথ চেয়ে থাকি? 
দিল্লি তে প্রথম যখন যাই কলকাতায় তখন  ঘোর বর্ষা..কিন্তু দিল্লি তে মেঘের চিন্হ ও নেই..মাঝে মাঝে এক একদিন বৃষ্টি আসত,মন টা নেচে উঠত যেন বাড়ির চিঠি এলো...শুনেছিলাম সেবারে দিল্লির তুলনায় অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু আমার গাঙ্গেয় মন তাতে তৃপ্ত হয়নি... এই বিদেশে  বৃষ্টি আসে চকিতে, মেঘ হয়ে মুখ ভার করে থাকে যখন আকাশ তখন ও সে যেন লঘু ক্ষিপ্র মেঘ, এই এলো এই চলে যাবে; সে মেঘ "গাভীর মত চরে" না, সে মেঘ মনের সপ্তকে মল্লার বজায় না...ঝিরঝির বৃষ্টি সারাদিন ঝরে ঝরে কখনো বিরক্তি কখনো গান জাগে না, ভাবি ভাগ্যে কবিগুরু বাংলাদেশে জন্মেছিলেন,  নৈলে  এত বর্ষার গান পেতাম ই বা কোথায়?
যাই হোক, আজ যখন অকাল বর্ষা এসেই গেছে আমার ঝাপসা জানলার ক্নাচে, এই বেরন্গিন মেঘলা আকাশে, তখন সব কাজ ফেলে আজ বর্ষার কাব্য ই করি..দেখি যদি এই মেঘ কে অলকা না হলেও আমার প্রিয় শহর টাতে পাঠানো যায়: "যাও মেঘ বলে দাও আমি ভালো নেই".....

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...