শনিবার, ২৫ মে, ২০১৩

মিসিসিপির তীর থেকে

প্রিয় শ,

মিসিসিপি দেখে এলাম, জানিস শ। সেই ভূগোল বই এ পড়া নদী টা--"উত্তর আমেরিকার বুক চিরে মেক্সিকো উপসাগরে পাখির পায়ের মত ব-দ্বীপ তৈরী করেছে", সেই মিসিসিপি। আর দেখে এলাম এক অদ্ভূত শহর: নিউ অর্লিয়ান্স--যেখানে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে দেড়শ বছরের পুরনো ফরাসী মহল্লা আর আধুনিক skyscrapper, যেখানে এক রাস্তায় রাত নামলে নরক গুলজার হয় আর তার পাশেই আরেক রাস্তায় চলে স্নিগ্ধ কাব্য-আলোচনা, যেখানে ভুডু র পসরা সাজায় অজস্র দোকান, আর কাটরিনা-বিধ্বস্ত দের নিয়ে চলে টুরিস্ট ব্যবসা--এতসব বৈপরীত্য মিলে এক আশ্চর্য কোলাজ যাকে ভালো না বেসে পারা যায় না! 
প্রথম দর্শনে চমকে উঠেছিলাম--সেই সরু গলি, পাশে গায়ে-গা লাগিয়ে দাড়িয়ে আছে পুরনো সব বাড়ি, ফিলিগ্রী র কাজ করা ঝোলা বারান্দা--হঠাত উত্তর-কলকাতার এক দমক হাওয়া এসে লেগেছিল ঘরছাড়া মনে। তখন সবে সূর্য উঠছে, রাস্তার মোড়ে অনামী শিল্পী তার পসরা সাজিয়ে বসছে, ঠিক চৌরঙ্গী র ভোরবেলা যেন। ও পাশে মিসিসিপি তখন মেঘ-ছেড়া আলোয় রেঙে উঠেছে, অনেক দিন পর নদীর এমন রূপ দেখলাম--এদেশের অন্য সব নদীর মত শীর্ণকায়া নয়, আমাদের গঙ্গার মত কূলপ্লাবিনী পৃথুলা; ছটফটে তরুণী নয় সে, পূর্ণযৌবনা মাতৃমূর্তি। ঠান্ডা হাওয়ায় মন জুড়িয়ে গেল, আর হঠাত করেই আমার চেনা নদীটার জন্যে মন-কেমন করে উঠলো। এখানে নদীর ধার যত্ন করে বাধানো, পাশে একের পর এক সবুজ পার্ক, নদীর বুকে একের পর এক জাহাজের আনাগোনা, সিঙ্গাপুর স্কটল্যান্ড কত দুরের দেশ থেকে--আর আমাদের নদী পরে আছে অযত্নে অবহেলায়, বন্দর এর হতশ্রী দশা, এক টুকরো প্রিন্সেপ ঘাট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি তাকে। সুন্দর সাজানো ঘাট, পাশে ট্রাম রাস্তা আর মাথার ওপর মেঘলা আকাশে সী-গাল এর সাদা পাখার মধ্যে দাড়িয়ে মনে মনেই ঘুরে এলাম কলকাতা থেকে।
তারপর তিন দিন ঘুরলাম শহরের অলি-গলি তে। পুরনো ফ্রেন্চ-কোয়ার্টার যেখানে প্রথম ফরাসী প্রভুরা গড়েছিল উপনিবেশ, দাস-বিনিময় এর বাড়ি, ভৌতিক অনেক গল্পের পটভূমি পুরনো সমাধি-ক্ষেত্র, সব দেখলাম। ভালোবেসে ফেললাম কফি-হাউস এর মতন কাফে-দু-মন্দে কে, যেখানে রাত বারোটা তেও লেগে থাকে আড্ডা-রসিক দের ভিড়! দেখলাম রাতে বুরবন স্ট্রিট এর বদলে যাওয়া-- রঙ্গীন নেশায় মাতাল হয়ে ওঠা, কান পেতে নিলাম জ্যাজ এর জন্মভূমি তে আকাশে বাতাসে ভেসে থাকা স্যাক্সোফোন এর সুর, চেখে দেখলাম "কাজুন" খাবার গামবো, জাম্বালায়া কিম্বা অসাধারণ ফরাসী  মিষ্টি "বেইয়্নে", আর সবার চেয়ে বেশি করে দেখলাম মিসিসিপি কে।

সকালের আধো আলোয় নিদ্রালু মিসিসিপি, দুপুরের কড়া রোদে একটুকরো শান্তির মত উত্তাল হাওয়ার মিসিসিপি, সন্ধ্যের ভিড় এ খেই হারানো মিসিসিপি, রাতের অন্ধকারে ঝিকিমিকি আলোয় আর রঙ্গীন স্টিম-বোট এ জেগে থাকা মন-উদাস করা মিসিসিপি। আলাদা করে চিনতে পারলাম মিসিসিপির সত্তা, সে গঙ্গার মত পূর্ণতায় ঋদ্ধ নয়, মাতৃত্বের গরবে কেউ তাকে করেনি গরবিনী, সে যেন এক একাকিনী নারী--সব রূপ-সজ্জায় সেজেও সে যেন একলা কার অপেক্ষায় বসে আছে, কে যেন তাকে দূর থেকে দেখে ফিরে না গিয়ে আপন করে টেনে নেবে বুকে, তার ঝকঝকে সৌখিন সাজ লুটিয়ে দেবে আনন্দের অঙ্গনে--তাকে চিনবে বলেই বেনি এলিয়ে উদাসী বসে রয়েছে। সেই রূপ দু-চোখ ভরে নিয়েই ফিরে এলাম, আর মন ভরে রইলো কলকাতার জন্যে একরাশ মন-কেমন।
ভালো থাকিস। এই বৃষ্টি-ভেজা অষ্টিন এর বুক থেকে পাঠিয়ে দিলাম কলকাতার জন্যে অনেকটা শুভেচ্ছা--ভালো থেকো, আমার শহর।
ইতি 
স্বাগতা 

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...