রবিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

তিমিরবিলাসী

হেমন্তের কবি জীবনানন্দ 
তখন আমি ছোট, তখন রবীন্দ্র-আক্রান্ত আমার কাব্য-চেতনা। বড়জোর নজরুল এর বলিষ্ঠ ছন্দময়তায় মাঝে মাঝে মুগ্ধতা আসে, কিম্বা সুকান্তের তীব্র প্রকাশ্যতায় জাগে উদ্দীপন--কিন্তু মনের গভীরে যেইখানটায় কবিতার গভীর আরাম পেতে চাই সেখানে শুধুই রবিঠাকুরের বিপুল বিথার। সেই রকম সময়েই এক থমথমে দুপুরে মামার বাড়িতে প্রথম চিনলাম জীবনানন্দ কে। গরমের দুপুর, ঘুমিয়ে আছে মধ্য-কলকাতার পুরনো সেই পাড়া--কার্নিশ থেকে একলা ঘুঘুর ডাক আর রোদে পুড়ে যাওয়া ছোট্ট গোল বারান্দাটায় আমি আর রূপসী বাংলার এক বহু পুরনো সংস্করণ--দাদুর বই এর তাক ঘাটতে গিয়ে হাতে পেয়েছি সদ্যই। মলাটে সত্যজিতের আঁকা সেই প্রচ্ছদ টা এখনো খুব মনে আছে, আর মনে আছে সেই প্রথম আবিষ্কার এমন এক কবি কে যিনি অক্ষরের অনায়াস বিন্যাসে গ্রীষ্মের তীব্র দুপুরেও নামিয়ে আনতে পারেন বিষন্নতার সন্ধ্যা। যার "চিত্ররূপময়" কাব্য পুরনো কলকাতার ঝুলবারান্দায় এনে দিতে পারে "বাংলার নদী-মাঠ-ভাটফুল" এর স্পর্শ। জীবনানন্দ দাশ।

তারপর আরো পরিচয়, রূপসী বাংলা থেকে ধূসর পান্ডুলিপি, মহাপৃথিবী বা বেলা-অবেলা-কালবেলার পাতায় পাতায়। পরিচয় বনলতা সেন, সুদর্শনা এবং সুরঞ্জনা র সঙ্গে, যারা নইলে বাংলার কাব্যজগত একলা হয়ে যায়, যারা নইলে নীরা র আসাই হত না হয়ত। পরিচয় পাঠ্য বইতেও, যেখানে প্রানপনে বুঝতে এবং বোঝাতে চাইতে হত কেন লেখা হলো "কালিদহে কখন যে ঝড় / কমলের নাল ভাঙ্গে ছিড়ে ফেলে গাংচিল শালিখের বুক" কিম্বা "জলাঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলার সবুজ করুন ডাঙায়।" এবং হতাশা--যে পংক্তিগুলি মন কে এমন করে ভিজিয়ে দিয়ে যায় এমন করে ডুবিয়ে দিয়ে যায় তাদের নাইবা হত এমন কাটা-ছেড়া--এই যে আমি বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথায় বুঝতে পারছি কেমন করে "হৃদয়ে খুদের গন্ধ লেগে থাকে আকাঙ্খার" নাইবা তাকে বুঝতে চাইলাম .. জীবনান্দের কবিতার উত্তর লিখতে যেমন কষ্ট হত, যেমন করে নিজেকে হত্যাকারী মনে হত তা আর কক্ষনো টের পাইনি। 
আবার ছিল সেইসব কবিতাও যারা ভয় দেখাত-- বড় রূঢ়, কর্কশ টানে সেই অনাস্থার সেই "অদ্ভূত আধারের" যুগ কে একে নিত, "লাশকাটা ঘরে"র ভয়াবহতা নিয়ে যারা বাসা করে নিত মাথার মধ্যে। কখনো যেন বড় বেশি বাস্তব, কখনো যেন বড় বেশি প্রকাশ্য। আবার কখনো তারা হেমন্তের শিশিরের মত, দূর থেকে দেখেই আশ মেটাতে হয় কাছে গিয়ে স্পর্শ করার অবাধ অধিকার নেই সেই নিবিড় একান্ততার মধ্যে। সেই আধ-বোঝা-না-বোঝার মধ্যে কত না রহস্য কত না গোপনীয়তার সঙ্গে আলাপ জীবনান্দের কবিতায়।
জীবনানন্দ আমার কাছে সেই কবি যার কবিতায় বাসা বেধে আছে আমার ধূসর মন-খারাপেরা, আমার আলো-আধারির কিশোরবেলা, আমার নিজের মধ্যে ডুব দেবার প্রথম পাঠ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির শুভ জন্মদিনে তাই আরো একবার ফিরে যাই তার ই সৃষ্টির মধ্যে।


সুরঞ্জনা


শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

অনেক দিন বাদে কালি-কলমে রোজনামচা লিখতে বসা, অনেক দিন বাদে বহতা জীবনের এক টুকরো ধরে রাখার ইচ্ছে, অনেক দিন বাদে উপচে পড়া মন-কেমন .. এই শীতার্ত রাত, বুক-ভরে-নেওয়া এই হিমেল হাওয়া মনে করিয়ে দেয় বেচে থাকাটা কত সুন্দর কত প্রানবন্ত, আবার তার ই মধ্যে দিয়ে যায় এক-আকাশ ভর্তি অভিমান আর মন-কেমনের  ঢেউ। ভালো-থাকা খারাপ-থাকা মিলেমিশে একটা ভীষণ জটিল জ্যামিতিক নকশা হয়ে যায়, বা দুর্বোধ্য কোনো আধুনিক কবিতা। হয়ত এই দ্বিত্ব-টুকুর নাম ই জীবন, হয়ত এই আলো-আধারি না থাকলে এত রহস্যময় হতে পারত না এগিয়ে চলা। এখন এই আনন্দ-পূত অথচ বিষাদ-খিন্ন, ধ্যান্স্তব্ধ এক মুহুর্তে বসে আছি আমি আর আমার মন-কেমন; এক ছায়াছন্ন ভালো থাকার ওম ঘিরে রয়েছে যেন। জানি না কার জন্যে, বা জানি না কারোর জন্যে কি না, ভাসিয়ে দিলাম একগুচ্ছ শুভেচ্ছার চিঠি--ভালো থেকো।

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...