মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১২

এমন দিনে তারে বলা যায়...

বাইরে এখন গুরু -গর্জন আর অঝর বর্ষণ -- চেনা অস্টিন অচেনা রাতপোশাকে রহস্যময়ী--বাতানুকুলতার বাধা পেরিয়ে বৃষ্টির রিমঝিম ডেকে যাচ্ছে আমায়..এমন দিনে নাই বা হলো আমার পড়া-পড়া খেলা, রইলো পড়ে খোলা বই খাতা--আমি চললাম এই বৃষ্টির পথ বেয়ে আমার স্কুল-বেলায়...


স্কুল এর দিন গুলোয় বৃষ্টি কে ভয় পেতাম না মোটে (এখনো পাই না অবিশ্যি :)), ছাতা না আনার দুর্ভাবনা আসতই না মাথায়, বরং ছাতা আনলেও সেটার আড়াল দিয়ে কীকরে ভিজতে হয় সেটা খুব জানা ছিল :) স্কুল এ বর্ষা মানেই ক্লাস এর ফাকে কোনো দিদি কে ডাকতে যাবার ছুতো করে এ-বাড়ি ও-বাড়ি করা--science building  থেকে cristin ভবন আবার ফেরা , তারপর সপসপে ভিজে শাড়ির আচলে মাথা মুছে তৃপ্ত মুখে নিরীহ ভাবে আবার ক্লাস এ..স্কুল এ বর্ষা মানেই cristin বাড়ির বাগান থেকে ভেসে আসা জুই এর মন-উতল করা সুবাস..স্কুল এ বর্ষা মানেই বন্ধুদের সঙ্গে বর্ষার গানের অন্তক্ষরী.....


ক্লাস five এ বসতাম ক্রিস্টিন বাড়িতে..টিফিন এ বৃষ্টি হলে পরের ক্লাস এর দিদি র মেন বিল্ডিং থেকে আসতে অনিবার্য ভাবেই দেরী, আর সেই ফাকে আমাদের বৃষ্টি ভেজা, পরে দিদি এসে অশেষ বকুনি..পড়ার ফাকেও মন চলে যেত সামনের আমগাছ টার পাতায় পাতায় বৃষ্টি ফোটার আওয়াজে বা ভিজে কাকের ডাকে, বাকরণের  পাঠ হারিয়ে  যেত কোথায়..কোনো দিদি আবার এমন দিনে বইপত্র সরিয়ে রেখে কবিতা-গানের আসর বসাতেন সবাইকে নিয়ে, সে এক অন্যরকম আনন্দ...আর থাকত ছুটির সময়  মা দেরী করে নিতে এলে  কাগজের  নৌকো বানিয়ে উঠোনের জমা জলে ভাসিয়ে  দেওয়া..বৃষ্টি হলেই কি যেন এক বাধন ছাড়া আনন্দ চেনা বাস্তব জগতকে উড়িয়ে নিয়ে যেত, কখনো যেন আমি নববর্ষার  সেই ঘটে  বসা অন্যমনা মেয়েটি , কখনো hans anderson  এর টিনের সেই সেপাই যে বৃষ্টির নদী বেয়ে adventure  এ বেরোলো...


দুটো বর্ষার দিন খুব মনে  আছে: একটা দিন, সে অবশ্য বর্ষাকাল  নয়, রীতিমত পচিশে  বৈশাখ ..স্কুল ছুটি  কিন্তু আমাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের  জন্যে রিহার্সাল চলছে স্কুল এ ..এমন সময় আকাশ কালো করে ঝেপে  এলো বৃষ্টি...দিদি রা টিফিন এর সময় অন্যদিকে  গেছেন  ঠাকুর  দালানে আমরা মেয়েরা বসে, হঠাত ই কি থেকে যেন শুরু হয়ে গেল রবীন্দ্র সঙ্গীত আর কবিতা, স্বত:স্ফূর্ত পচিশে বৈশাখ উদযাপন..গানে গানে কবিতায় কখন বিভোর হয়ে গেছি মরা সবাই, দিদি রাও কখন শুনতে পেয়ে এসে যোগ দিয়েছেন, কন্ঠ মিলিয়েছেন বুঝতেও পারিনি..সে বিকেল টা আমার স্মৃতি তে খুব দামী হয়ে রয়ে গেছে..কোনো রবীন্দ্র-স্মরণে আর তেমন স্বত:স্ফূর্ত আনন্দ পাইনি..তখন মন টা থাকত ভারী উচু সুরে বাধা, বাস্তবের করা আচ জানতেই পারিনি স্কুল এর ছায়া-নিবিড় আশ্রয়ে থেকে..আজ সেইসব বিকেল ভারী অলীক বোধ হয়..



আরেকদিন..সে ঘোর বর্ষার দিন..দুপুরে ই হঠাত নেমে এলো রাতের ঘন অন্ধকার..কোন এক ক্লাস এর দিদি আসেন নি, আমরা ক্লাস ঘরে আলো নিভিয়ে সেই অন্ধকারে বসে আছি..তখন ক্লাস টেন, ক মাস পরেই ছেড়ে যাওয়া স্কুল, কে কোন পথে চলে যাবে কোন ঘাটে লাগবে কার তরণী, কেউ জানিনা..বাইরের চরাচর-প্লাবিত সেই অকাল-সান্ধ্য অন্ধকার আর ভিতরে এতদিন এক বৃন্তে বেড়ে ওঠা আমরা কজন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে...ফিসফিস কথা হচ্ছিল, আধ-দু কলি গান..সব জুড়ে গভীর এক অনুভব...টিফিনের পর অঙ্ক ক্লাস--শুক্লা দি আমাদের উচাটন মন দেখে অনুমতি দিলেন, দুটো অঙ্ক করে দেখিয়ে নিলেই আমরা বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখতে পারি..তড়িঘড়ি অঙ্ক করে চলে গেলাম বারান্দায়..আধার-ঘন উত্তর কলকাতা চারদিকে, দুরে উথাল-পাথাল গঙ্গা,মন উদাস করা হাওয়া এ ভেসে আসা বৃষ্টির ছাট--কি যে দেখেছিলাম সেদিন বারান্দায় কে জানে--কেন যে বৃষ্টি বলতেই সেই মন-কেমন করা দুপুর গুলো মনে পড়ে আর বন্ধু বলতেই সেই চুপ করে পাশাপাশি দাড়িয়ে থাকা মুর্তিগুলো তাই বা কে জানে..


সেই গঙ্গা আজ ও বর্ষায় এমনি উত্তাল হয়, সেই স্কুল বাড়িটাও এক ই আছে--শুধু সেই আমি টাকে কোথাও খুঁজে পাইনা.. এমন কোনো বৃষ্টিভেজা রাতে খুব মন কেমন করে--সেই স্কুল টার জন্যে, সেই বন্ধুদের জন্যে,সেই আমি টার জন্যে.......







২টি মন্তব্য:

  1. গায়ে কাঁটা দিল স্বাগতা। আমার স্কুলের গল্পটাও অবিকল এইরকম। আর যে দুপুরটার বর্ণনা দিয়েছ, অনবদ্য। মনে হল বৃষ্টির ছাঁট গায়ে এসে লাগছে আমারই।

    খুব খুব ভাল লিখেছ।

    উত্তরমুছুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...