শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৫

তোমার গোকুল ছিল, কদমের ঘন নীল ছায় 
তোমার যমুনা ছিল, তোমার উদাসী পূবে বায় 
তোমার রাখল-সাথী, তোমার কপোত-প্রেমকথা 
তোমার নিকোনো ঘর, তোমার ছোঁয়াচে চপলতা 

কোন সকালের আলো উদাস মল্লারের তানে 
পথের ব্যাকুল ডাক এনে দিল তোমার চেতনে 
অনর্গল বিশ্ব এলো তোমার নিভৃত কুঞ্জদ্বারে 
প্রথম যাত্রার ধ্বনি~ চেয়ে দেখা কুতূহল ভরে 

এখন তোমার পায়ে ধূলি-অঙ্কিত বিশ্বালাজ 
পথের গম্ভীর ধ্বনি শিরায় মন্দ্রিত তব আজ 
এখন সমুখে তব আকাশের বিপুল বিথার 
এগিয়ে চলার ক্ষণ, ফেরার সময় নেই আর 

তোমার বসন গেছে, রিক্ততার আভরণ সার 
তোমার নিভৃত শান্তি টুটে উঠে তরঙ্গ হাজার 
তোমার অঙ্গন গেছে, বদলে পেয়েছ এ আকাশ
তোমার প্রেমের সুখ হারিয়ে পেয়েছ দীর্ঘশ্বাস 

যাত্রার শুরু এই, এমন ই যে এ পথের দাবী
নিজের যা কিছু ধন সব এই পথেই হারাবি 
সকল ক্ষুদ্রতা ফেলে আজ তুমি ব্যাপ্ত চরাচরে 
ফিরো না, ফিরো না, পান্থ, অকুলান তোমার সে ঘরে 

সমস্ত বিশ্বের পরে আজ তোর দৃপ্ত অধিকার 
ভুলে যাও ফেলে আসা বিদায়ের যত মনোভার 
ভোল প্রেয়সীর আঁখি, ভোল শান্ত ব্রজের আঙ্গন 
পথের মহান মন্ত্রে আজ যে তোমার আবাহন 

অনন্ত যাত্রায় চল, বন্ধ থেকে চির-মুক্তি-পানে 
গোকুল-মথুরা বেড়ে পথের অনির্দেশ্য় টানে.... 










রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৫

ভরা আষাঢ় বঙ্গোপসাগরে
তোমার চোখে তখন ও বৈশাখ
বেলাভূমির পায়ের ছাপ বুঝি
ভুলেই গেছে কে দিয়েছিল ডাক

ডাক পাঠালে, মেঘ-থৈথৈ বেলা
তোমার বুকে ঢেউ-এরা উচ্ছল
~"সাগরপারে আবার দেখা হবে"~~
--পূবে হাওয়াই আমার সম্বল

এলাম তাই হাওয়ার-ই হাত ধরে
সকাল থেকে অপেক্ষার ক্ষণ
কোন ঢেউ-এতে তোমার ই নাম লেখা
কোন হাওয়াতে তোমার ই গুঞ্জন

এখন তোমার অকুল বিথার; দেহে
এখন তোমার সিক্ত লবণতা
এখন তোমার অনেক সাথী, নদী,
এখন কি আর ভাববে আমার কথা?

তোমার জন্যে  যে মন আনলাম
এই মোহনায় আলগোছে থাক পড়ে
তোমার-আমার গাঙ্গেয় আলাপ ও
রেখে এলাম তোমার অগোচরে ।।

শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৫

তোমার আহত চোখ, ভীরু হরিণীর অভিমান
বিন্দু বিন্দু সেঁচে তোলা তোমার অননুবিদ্ধ ঘ্রাণ
তোমার ব্যথার নীড়ে বড় কাছে পেয়েছি তোমায়
অকালবর্ষণে এস, ওগো পূরবীর মৃদু বায়...

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫

গাঙ্গেয়

ওর সঙ্গে আমার আলাপ লঞ্চ এ। হাওড়া-বাগবাজার সকাল নটার লঞ্চে রোজ দেখতাম, হালকা রঙের শাড়ি পরা, কালো কাপড়ের ব্যাগ হাতে, কেমন যেন ধূসর চেহারা। পুরনো দিনের ফ্রেম অলা চশমা চোখে, চশমা টা খুললে দেখতাম চোখ দুটি আশ্চর্য সুন্দর। লঞ্চের কেজো ভিড়ের মধ্যে ওর নির্বিকার শান্ত নদীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকা ওকে সবার থেকে অনেক আলাদা, অনেক দূরের করে দিত। ভালো লাগত। কথা বলতে ইচ্ছে হত খুব ই, পারতাম না। উত্তর কলকাতার এঁদ গলিতে এক সাহিত্য-পত্রিকার অফিসে চাকরি করি আর কবিতা লিখি, মেয়েদের সঙ্গে যেচে আলাপ করার সাধ্যি কই । 
তবু, আলাপ হয়েই গেল। কি এক কারণে লন্চ বন্ধ সেদিন, ভিড়ভাট্টায় দিশেহারা চোখদুটো হঠাত জড়তা কাটিয়ে দিল,  বাস এ যেতে যেতে কথাও হলো খানিক। নাম... না থাক, শুনলে চিনে ফেলতে পারেন-- ধরুন, ধারা। রথতলার দিকে থাকে, বছরখানেক আগে বাবা মারা গিয়েছেন, আর কলকাতা ইউনিভার্সিটি তে সংস্কৃত নিয়ে মাস্টার্স করছে। কথা হলো এই, তবে কথার বাইরেও, একটা আলাপ হয়ে গেল। এতটা আলাপ, যাতে পরের দিন ফোন এ আগামী শনিবার বাবুঘাট এ দেখা করার প্লান ও করে ফেললাম দুজনে। কখনো ভাবিনি কোনো মেয়ের সঙ্গে এরকম একলা দেখা করতে যাব, কিন্তু কেমন যেন সাবলীলভাবেই কথা হয়ে গেল, যেন ওকে কতদিন চিনি, যেন লজ্জার দূরত্ব থাকার কথাই  নয়!

সেদিনের প্রিন্সেপ ঘাট ভারী মনোরম। এক পশলা বৃষ্টির পর মেঘলা আকাশ আর পূবে হাওয়ায় সুন্দরী গঙ্গা। ছোট ছোট ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কচুরিপানার দলগুলো। হালকা গল্প চলছিল, টুকটাক। ধারা কাদম্বরী পড়ছে এখন, গল্পটা বলছিল। তপস্বিনী মহাশ্বেতা র পুণ্ডরীকের জন্যে তপস্যা, সেদিনের শান্ত গঙ্গা আর ধূসর শাড়ির বিষণ্ণ চোখের ধারা, সব মিলিয়ে কেমন একটা ঘোর লেগে গেল। কবিতার দুটো পংক্তি হঠাত ভেসে এলো মনে, এত তীব্রভাবে, যেন না লিখতে পারলে চলছে না। ধারার থেকে একটা কাগজ কলম চাইলাম।
"লিখবে?"
"কবিতা। এক্ষুনি লিখি, নইলে যদি ভুলে যাই?"
ধারার চোখ পলকে উজ্জ্বল, এক মনে দেখল আমার লেখা। তারপর চাইল। কলম নিয়ে কি যেন কাটাকুটি করে ফেরত দিল আমার খাতা। অবাক হয়ে দেখি, আমার কবিতা সামান্য কিছু শব্দবিন্যাস পাল্টে নতুন হয়ে গেছে, আরো সুন্দর, আরো মন-ছোঁওয়া। খুব হালকা লাগছিল, খুব খুশি। এক মুহূর্তে যেন খুব কাছাকাছি এসে গেছি দুজনে। কদিনের আলাপ পেরিয়ে আমরা যেন চির-সহচর হয়ে গেছি।
"এ কবিতাটা আমায় দেবে?"
"এ তো তোমার ই কবিতা, ধারা"
"না, দুজনের। দাও, আমি এই কবিতা গুলো আলাদা করে রেখে দেব। এগুলো শুধু আমাদের জন্যে, এগুলো তুমি ওই সব পত্রিকায় ছাপতে দিতে পারবে না। কেমন?"
"নষ্টনীড় এর চারু র খাতা? তা বেশ, তাই থাকুক"-- নিজেকে মনে হচ্ছিল খুব ধনী, যেন ধারা চাইলে আমি আমার সাম্রাজ্য টাই ওর পায়ে লুটিয়ে দিতে পারি। ছোট থেকে ডানপিটে দাদা আর তিরিক্ষে বাবার ভয়ে জড়োসড়, পৃথিবী র থেকে বাঁচতে শামুকের মত খোলে ঢুকে থাকা আমাকে ছোট্ট কথাগুলো যেন প্রথম ডানা মেলতে শেখালো। বুঝতেই পারছেন, গদ্যেও কবিতা করে ফেলছি সেদিনের কথা ভাবতে গিয়েই।


তারপর, প্রতিদিন সকালে লঞ্চঘাট থেকে দুশ-চল্লিশের স্ট্যান্ড অবধি টুকরো কথার স্রোত, আর শনিবারে প্রিন্সেপ ঘাট, আর একটি করে দ্বৈত কলমে লেখা কবিতা। আমি বদলে যাচ্ছিলাম। অফিসে বসের দিকে তাকিয়েও সৌজন্যের হাসির সাহস পাচ্ছিলাম, বাড়িতে দাদার কাছে মায়ের ভেঙ্গে যাওয়া চশমা মেরামতের জন্যে দরবার করতে কুন্ঠা হয়নি, রোজ রাতে বাড়ি ফিরে মায়ের সঙ্গে সিরিয়াল দেখা ছেড়ে মুদ্রারাক্ষস এর অনুবাদ নিয়ে বসছিলাম। যেন অন্য আমি, যে আমিটার স্বপ্ন দেখতেও আগে ভয় পেতাম। আর, শনিবারের কবিতা গুলো ও আরো বেশি ভালো হয়ে উঠছিল। এখন প্রথমে এসেই জায়গা খুঁজে বেঞ্চিতে বসে পরেই কাগজ কলম বার করি। মাথায় গুনগুন করতে থাকে কিছু লাইন, ধারা ও পাশ থেকে জায়গা মত শব্দ বলে দেয়,আধ ঘন্টার মধ্যে জন্ম নেয় আমাদের যৌথ সৃষ্টি। ধারা উদ্দীপ্ত আগ্রহে আবার পড়ে, তারপর অসীম মমতায় হাতব্যাগ এ ভরে নেয় পাতাটা। কি আনন্দ, কি অদভূত ঘোর তারপরের গোটা সময়টা জুড়ে থাকে। হাঁটি না, যেন ভেসে ভেসে ঘুরি ময়দানের দিকটা, ঘাসের মধ্যে মিশিয়ে দিই নিজেকে, ঝালমুড়ি খেতে গিয়ে লঙ্কা চিবিয়ে ফেলে ঝালে অস্থির ধারার মুখটা দেখি। বেঁচে থাকি ভীষণভাবে, যেমনটি কখনো বাঁচিনি। 
ধারাকে বলি, কবিতা লেখ না কেন সিরিয়াসলি? ধারা ওর স্বাভাবিক অন্যমনস্ক নির্বিকারতায় হাসে। 

সপ্তা পাঁচেক গেল। কিন্তু এবারে ভারী অস্থির লাগতে শুরু করলো আমার। প্রতি সপ্তায় ওই একটি কবিতা লিখি, লিখি মন উজাড় করেই, কিন্তু সে তো রয়ে যায় ধারার কাছে। আমাদের দুজনের যৌথ ফসল, সে কি দিনের আলোর মুখ দেখবে না কোনদিন ও? ভালো হয় কবিতাগুলো, ছবির মত, নদীর মত সুন্দর। শনিবারে বাড়ি ফিরে তারা তাড়া করে বেড়ায় আমাকে, প্রকাশের আকাঙ্ক্ষায়। আর, কেন জানিনা, বাকি সারা সপ্তাহে কবিতা আসেই না কলমে। শুধু পড়ি, ভাবি, আর অপেক্ষা করি শনিবারের।

পরের সপ্তাহে ধারা ব্যাগ খোলার আগেই বললাম, " ধারা আজকের কবিতাটা থাক না। সামনের মাসে একটা লিটল মাগাজিন থেকে লিখতে বলেছিল, দুজনের নামে পাঠিয়েই দিই নাহয়?"
"ছাপাবে?"-- আহত, আকুল ধারা।
"না, মানে, একটা ছাপাই ? বাকি গুলো তো রইলো ই শুধু দুজনের জন্যে? একবার বরং সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিই আমাদের অস্তিত্বটা?"
জেদী, একগুঁয়ে গলায় ধারা বলল "না।"
বলেই, ঢুকিয়ে রাখল কবিতাটা।
সুর কেটে গেল দিনটার। শ্রাবণ সন্ধ্যায় আকাশ ও ঘন কালো, কালো নদীর বুক, বিদ্যুতের ধমকানি--তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলাম। কেমন একটা লাগছিল, যেন না ফুরোনো গল্প, তান কেটে যাওয়া রাগিনী। চট করে খাতা নিয়ে বসলাম, লিখে ফেলতে হবে আজকের কবিতাটা। এভাবে বোকা জেদের কাছে হারিয়ে যেতে দেব না আমাদের সৃষ্টিকে। আর, ছাপা হয়ে গেলে ধারা ই তখন হয়ত খুশি হয়ে উঠবে, বুঝবে নিজের বোকামি।

কি আশ্চর্য, একটা লাইন ও মনে পড়ল না, এই কয়েক ঘন্টা আগে লেখা, এত প্রিয় কবিতাটার!


পরের শনিবারে কবিতা এলো, কিন্তু ভারী দায়সারা, ভারী অনিচ্ছুক। ধারা কবিতাটা রেখে দেবার পর চুপচাপ বসে রইলাম দুজনে। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল, আমরা আইস-ক্রিম পার্লারের কাঁচ দিয়ে দেখছিলাম বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া উত্তাল গঙ্গা। ধারা আজ একটা গেরুয়া শাড়ি পরেছিল, পাশে বসেও ওকেও ওই গঙ্গার মতই দূরের, ঝাপসা লাগছিল। অন্যমনে বলল, ওর থিসিস এর কাজ চলছে, এখন কদিন ইউনিভার্সিটি যাবেনা। অস্থির লাগছিল, ঝড়ের আগের শান্তি যেমন অস্থির। মনে হচ্ছিল কিছু যেন ঘটবে, যেন কোন অমোঘ পরিণতির টানে আমরা দুজন খড়কুটোর মত ভেসে চলেছি। 

সপ্তাহটা কাটল পাগলের মত। সকালে শার্ট ইস্ত্রী করতে ভুলে গেলাম, অফিসে চেকবুক হারিয়ে অপদস্থ হতে হলো সবার কাছে, বৌদি টাকা না নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ঠাট্টা করে বলল প্রেম করছ নাকি। নিজের মধ্যে নিজে কোনঠাসা হয়ে পড়ছিলাম। হতাশ, দিশেহারা দিন; দীর্ঘ, অসহ রাত্রি।

শনিবার সকাল থেকে বৃষ্টি, রাস্তায় জল ঠেলে উদ্ভ্রান্তের মত লঞ্চঘাটে পৌঁছে দেখি লঞ্চ বন্ধ, আর ঘাটের ব্রিজ এর ওপর একলাটি দাড়িয়ে আছে আকাশী শাড়ির ধারা। পাশে গিয়ে দাড়াতেই ফিরে তাকালো আমার দিকে, ছোট্ট একটু হেসে একটা কাগজ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "দেখো।"
চার লাইনের কবিতা। অন্ত্যমিল নেই, ছন্দ ও। শুধু ওই বর্ষার গঙ্গা আর ভিজে হাওয়ার মত, খুব নির্জন, খুব উদাস। এমন কবিতা আগে পড়িনি, লিখিনি তো বটেই! ভরা নদীর মত বুকটা ভরে গেল পূর্ণতায়, ধারার হাতটা চেপে ধরে বললাম, "এই কবিতাটা আমি নেবই ধারা, ইটা আমি তোমার নাম ছাপাবই। কত প্রশংসা পাবে তুমি দেখো, কত ভালো লাগবে। এটা দিতেই হবে তোমায়। " 
বিষণ্ণ হাসলো ধারা, "নেবেই?"
সাহস পেয়ে বললাম, "হ্যা, নেবই। আর, বাকিগুলোও নেব। সবকটা ছাপতে দেব, একটা সিরিজ এর মত করে। ভালো হবে না, বল?"
" বাকি? বাকি তো নেই"
"নেই? তোমার কাছে?"
"আমি নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি যে। নদীর দেওয়া কবিতা, নদীকেই দিয়ে দিয়েছি।"
"নদীতে? মজা করছ?"
দৃঢ় চোখ তুলে তাকালো ধারা। পাগলের মত হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিলাম আমার হাত। ওর কবিতাটা হাতে নিয়ে দৌড়ে চলে এলাম বাড়ি। আর কক্ষনো দেখা করব না ওর সঙ্গে। আমাদের সৃষ্টিকে কেমন করে মেরে ফেলতে পারল ও? এত অবলীলায়? এত নির্বিকার ভাবে?

আমার গল্প ফুরিয়ে এলো। ওর আসল নাম ছিল জাহ্নবী । চেনা লাগছে, না? আজকের কাগজের প্রথম পাতায় দেখে থাকবেন, প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে জলে ডুবে আত্মহত্যার খবরে নাম বেরিয়েছে। আর, ওর ব্যাগ থেকে পাওয়া গেছে পলিথিন প্যাকেট এ মোড়া, যত্ন করে রাখা সাতটি কবিতা। আমাদের দুজনের নাম লেখা: জাহ্নবী ও শান্তনু । 


রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

এমন কেন সত্যি হয়না আহা: পর্ব ২: কৌন্তেয় কর্ণ

(ব্যর্থতা বহু-স্তরী। আমাদের চেনা গল্প, চেনা ইতিহাস, চেনা দুনিয়া জুড়ে অনেক ব্যর্থতার কাহিনী আছে, যারা কাঁদায়, ভাবায়। সেই সব কাহিনী কে নিয়েই এই সিরিজ~ ঠিক কোনখানে ব্যর্থতা আর সফলতা এক হয়ে যায়, সব ব্যর্থতা ই বেদনার কিনা, আর কোন কাহিনীতে ব্যর্থতা টুকু সরিয়ে নিলে সে গল্প আরো ধুসর, আরো নির্মম হয়ে ওঠে, তার ই সন্ধানে এই লেখা। আজকের চরিত্র: কর্ণ।)

সভাকক্ষের বিশাল গবাক্ষপথে আসিয়া পড়িতেছে সন্ধ্যা-সবিতার বিলীয়মান দুই একটি রশ্মিচ্ছটা। সম্মুখের প্রত্যাশী জনতার দাবি ফেলিয়া আজ আমার সান্ধ্যান্হিক সারা হয় নাই পুণ্য জাহ্নবীর তীরে। আমি, কর্ণ। হস্তিনাপুরাধিপ, পান্ডব-অগ্রজ কর্ণ। দেখ, ললাটে কেমন জ্বল্জ্বলাট বংশগরিমার তিলক, মাথায় কেমন স্বর্ণমন্ডিত রাজমুকুট, বাহুতে কেমন অমিত-বল এর সংহত রূপ-- আমি উঠিয়া আসিয়াছি, রিক্ততার, বঞ্চনার, কুল-শীল-মান-হীনতার অন্ধকার গর্ভ হতে। আমি, কর্ণ। বামপার্শ্বে ব্যজনরত ওই ধীমান যুধিষ্ঠির, ডাহিনে  অলস অর্ধশযানে ওই বহুবলী ভীম, সম্মুখে উপবিষ্ট ওই সুপুরুষ মদ্র ভ্রাতৃদ্বয়, আর পশ্চাতে রাজ্ছত্রধারী ওই গান্ডীবধারী অর্জুনের জ্যেষ্ঠ, আমি কৌন্তেয় কর্ণ।
আমি কর্ণ, তবু সেই শালপ্রাংশু-মহাভুজ, রথিশ্রেষ্ঠ, দানবীর কর্ণ নহি, যাহাকে তোমরা চিনিতে। যদিও এখনো আমার ক্ষাত্রতেজ উদ্দীপ্ত দুই বাহুতে, যদিও এখনো নির্ভুল আমার শর-যোজন, যদিও এখনো প্রার্থীর বিফলতা দেখিতে হয় নাই আমায়, তবু, আমি সে কর্ণ নহি আর। আমার সে প্রশস্ত দাম্ভিক ললাট আজ মেঘাছন্ন বন্ধুদ্রোহের গ্লানিতে, আমার সে আত্মশুদ্ধির গৌরব~ যা কবচ-কুন্দলের চেয়েও সোচ্চারে আমার পিতৃ-পরিচয় ঘোষণা করিত, আজ তা পরাজয়ের অগৌরবে, অধমর্নের লজ্জায় লিপ্ত। সে কর্ণের মৃত্যু ঘটেছে কুরুক্ষেত্রের রণ-ভীষণ সেই মুহূর্তে, যখন সহসা মেদিনিবিদ্ধ আমার রথচক্র, সহসা বিস্মৃতির অভিশাপ আমার অজেয় অস্ত্র-সম্ভারে, যখন অর্জুনের উদ্যত বাণ ই এক অন্তিম পরম সত্যের মত স্থির, নিশ্চিত। তাহার পর পার্থ-সারথির উচ্চকিত নিষেধ, অর্জুনের কাছে আমার কৌন্তেয়-পরিচয়-দান, আর বিস্মিত, স্তব্ধ সব্যসাচীর অস্ত্র-সংবরণ যে কর্ণ কে নবজীবন দান করিল, সে কর্ণ অধিরথ-সূতপুত্র নহে, অজ্ঞাত-শীল বীর মাত্র নহে, আপন চরিত্রবলে আপনি সুন্দর সেই কর্ণ নহে। আমার প্রানের মূল্যে আমি তখন পান্ডব-ঋণে ঋণী, এক লহমায় ছাড়িতে হইল মিত্রশ্রেষ্ঠ সু-যোধনের আলিঙ্গন, ছাড়িতে হইল অর্জুনের সহিত চির-প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ছাড়িতে হইল বীরোচিত গৌরবের মৃত্যুর এষণা। সেই আশ্চর্য মুহূর্তে এক ই সঙ্গে আমি লভিলাম আমার আজন্ম-কাঙ্খিত বংশ-গৌরব, আর হারাইলাম আমার আজন্ম-সাধিত বীরধর্ম। আজ আমি এক পরাজিত রাজা, এক রাজমুকুট-ধারী ক্রীতদাস মাত্র।
বিশ্বের স্পৃহনীয়তম সিংহাসনে বসিয়া আছি, অথচ এমন নি:স্ব এমন কাঙ্গাল আর নাই। রাজপদ থাকিতেও আমি মর্যাদা-হীন~ আমার শিক্ষার ন্যূনতা, আচরণের অনুপযোগিতা আমায় প্রতিমুহূর্তে ব্যঙ্গ করিয়া চলে। পঞ্চ-ভ্রাতা থাকিতেও আমি আত্মীয়-হীন~ অসীম ঋণের বাধা, অসীম দয়ার বন্ধন তাহাদের সঙ্গে রচিয়াছে দুর্লঙ্ঘ ব্যবধান। অতুল শৌর্য থাকিতেও আমি হতবল~ আমার চির-প্রতিদ্বন্দ্বী সব্যসাচীর দয়া অপহরণ করিয়াছে আমার বীরসম্মান। বহু-প্রার্থিতা দ্রুপদ-নন্দিনীর সান্নিধ্য থাকিতেও আমি একা~ তাহার অতুল ঘৃণা পার হইয়া তাহাকে লভিব এমন সাধ্য কোথায়। আজন্ম-বন্চিত মাতৃপরিচয় মিলিতেও স্নেহের আশ্রয় মেলে নাই আমার~ জানিয়াছি, স্নেহের সে দাবি বহুকাল তামাদি হইয়া গিয়াছে, তাহাকে কোনো যত্নেই পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নহে। এখন শুধু একাকিত্বের, পরাজয়ের এ দারুণ  গ্লানি বহিয়া ব্যর্থ কর্ণের এই দিন-যাপন, উদয় হইতে অস্তাচলের পানে, গৌরবের মধ্যান্হ হইতে পরাজয়ের সায়ম-এর পানে, অস্ত্র-পরীক্ষার নব-উদয় হইতে মহাপ্রস্থানের অন্তিমের পানে।

বুধবার, ২০ মে, ২০১৫

এমন কেন সত্যি হয়না আহা ~~ পর্ব ১: রাধা

(সাহিত্য কিম্বা ইতিহাসে কত না চরিত্র কেন জানি খুব কাছে চলে আসে মনের। কখনো বুঝি মনে হয়, কেমন হত যদি তাদের জীবন তা অন্যরকম হত? তাদের দুঃখ গুলো না ই বা থাকত এমন করে?
সেই নিয়েই লেখা "এমন কেন সত্যি হয়না আহা"। আপাতত রাধা। দেখি কল্পনার দৌড় কদ্দুর যায়।)

এই সোনার প্রাসাদ-চূড়া থেকে আকাশটা অনেক কাছে এসে যাওয়ার কথা, কিন্তু মনে হয় যেন আরো অনেক দূর। কালিন্দীর তীরের সেই নিচু সবুজ ভূমি ও যেন কি কৌশলে ছুয়ে ফেলত আকাশ যখন তখন, অথচ এই মহলের পর মহল জোড়া সোনার প্রাসাদ পারেনা তাকে ছুতে। শুধু আশপাশে বিছিয়ে থাকা একচালা-দোচালা আর দু-একটি ধনীর হর্ম্য কে ছাপিয়ে যাওয়ার অহংকারেই তার সর্বাঙ্গে ফুটে বেরয় রাজরক্তের দ্যুতি। সেই সোনার ছিটে লেগে এখানকার আকাশটাও কেমন অন্য-রঙ্গা--কেমন যেন মেকি লাগে আমার।
ঠিক যেমন মেকি দেখাল দ্রুতচ্ছন্দে প্রাসাদ-শীর্ষে উঠে আসা ওই কিশোর কে, যার একূল-ওকূল আধার করা কালিন্দীর মত কালো গায়ে এখন সোনার পাড় দেওয়া পীতাম্বরের দ্যুতি। বাশের বাশিটির বদলে যার হাত এখন কোমরের তীক্ষ্ণধার তরবারির মুঠ এ। যার কপালে এখন ভ্রুকুটি--এক অচেনা বিরক্তির ছায়া পড়ে যার ভীষণ চেনা, ভীষণ প্রিয় মুখ টাও এখন ভারী অন্যরকম--ভারী মেকি। যে মেকি গলায় সে তার "প্রিয়ে " কে সম্বোধন করে বলে চলে কেন আমার দিনদুপুরে এমন করে ছাতে উঠে আসতে নেই, কেন তার সদ্যলব্ধ রাজ্যের প্রজারা যখন তখন তাদের রানী কে দেখে ফেললে রাজার মান-মর্যাদা ধূলিসাত হয়ে যাবে। না, আমি তো আর সেই কলসী-মাথায় গোপ বাড়ির আটপৌরে বউ শ্রীমতি নই, নই কুঞ্জছায়ার নীরবতা ভরিয়ে তোলা অনেক সাধের, অনেক ভালবাসার রাধা-- আমি এখন মথুরা-নগরপতির গোকুল-মহিষী, আমি এখন কেবল এক নারী।
অথচ সেই যেদিন অক্রুরের রথের চাকার নিচে প্রাণ পেতে দিতে চেয়েছিলাম, যেদিন ওই কালো রূপের আদল পেয়ে কালিন্দিতে ডুব দিতে গিয়েছিলাম, যেদিন ওই নওল কিশোরের ফেলে আসা শূন্য অঙ্গন যেন প্রবাস মনে হয়েছিল আমার চোখে, সেদিন তো এই মথুরার প্রাসাদ-শীর্ষ ই আসত ভোরের স্বপ্ন হয়ে, আকাঙ্ক্ষার তীব্রতম কম্পন হয়ে। অপূর্ণ তিয়াষা হয়ে সেদিন চোখের কাজলে কাজলে তার ই নাম; তদ্গত অনুভবে প্রতি অঙ্গে তার ই অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনের মূর্ছনা। কে জানত সে স্বপ্ন যেদিন সকালের প্রখর আলোয় সত্যি হয়ে ভাসিত হবে, সেদিন সেই চিরকৃষ্ণ, চিরসুন্দর কন্ঠে ধ্বনিত হবে না সর্ব-অভিমান-হর "দেহি পদপল্লবমুদারম", শুধু আমার কুঞ্জ-দ্বারে এসে দাড়াবে স্বর্ণ-লাঞ্ছন-ধারী মথুরার রাজ-রথ-- আমার প্রানের মানুষ দুহাত বাড়িয়ে টেনে নেবেন না তার বিরহিনী রাধাকে, শুধু জনারণ্যের সভায় সভাসদ দের উচ্চকিত জয়ধ্বনিতে আমি দেখতে পাব রাজবেশ-মন্ডিত, গর্বিত, স্থিতধী এক রাজা কে, আমার কৃষ্ণ তো সে নয়! আমার কৃষ্ণ তো এমন মহিমান্বিত রাজা নয়, সে যে পথের রাখাল--আমার কৃষ্ণ তো এমন কূটনীতিজ্ঞ স্থিতধী নয়, সে যে বাশরীর সুরে ভেসে চলা এক উদাসী কিশোর, সে যে আমার যমুনা-পথের বাকে থির হয়ে থেমে থাকা ধৈবতের সুর, সে যে আমার অথির বিজুরির অভিসার-রাতে চির-চঞ্চল একমুঠ জোনাকি। তবে আমি যাকে ভালোবেসেছি সে কি শুধু সেই মুহূর্ত মুহূর্ত দিয়ে গেথে চলা মালা-টুকু? সে কি শুধু সেই দু-কূল ভাসানো প্রেম-টুকু? সে কি শুধু সেই আমার ভিতর তিলে তিলে সৃজন করা আপন মনের মাধুরী মেশানো কৃষ্ণ-নাম-টুকু? তাই কি এই নির্বান্ধব মথুরায়, এই যদু-পতি কৃষ্ণের পাশে একাকিনী "স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি, ভারমুক্ত সে এখানে নাই"?

রবিবার, ১৭ মে, ২০১৫

এ গান শোনাব বিকেলবেলায়

অনেক দিন পর একটা ছবি দেখে ভাবতে ইচ্ছে করলো, লিখতে ইচ্ছে করলো। না, সিনেমা-বিশেষজ্ঞের ভাবনা নয়, তুখোড় সমালোচকের লেখা নয়, এ যেন নেহাত ই আমার গল্প, আমার মন-খারাপের রোজনামচা। ওপেন টি বায়স্কোপ। নব্বই দশকের উত্তর কলকাতার এক গলি। একটা মায়াবী কৈশোর, একটা আটপৌরে পাড়া, একটা অনাবিল বন্ধুতা, আর কিছুটা হারানো সময়। ভাবায়, কাদায়।
অথচ আমার গল্প টা ফোয়ারা র মত নয় আদৌ। মধ্য কলকাতার মেয়ে আমি, উত্তরে শুধু স্কুল-জীবন, যা আমায় গড়েছে--সেই সুতো ধরে উত্তর কলকাতা আমার শিরা-ধমনীতে। আমার গল্প তো নেহাত ই পুরনো ইস্কুলের ভালো, পড়ুয়া শান্ত মেয়ের গল্প; নিয়ম ভাঙ্গার বেপরওয়া কোন রং নেই। তবু ওই অশ্বথ্ব চারা-ওঠা বাড়ির সারি, গা-ছমছমে সরু গলি, ভাঙ্গা পাচিলের পাশে শেওলা-ধরা গঙ্গার ঘাট যেন আমার ই গল্প বুনে চলে। ভুলে যাওয়া গান, ভুলে যাওয়া স্মৃতি, ভুলে যাওয়া চিঠি পথ আটকে এসে দাড়ায়। চোখের কোণে উষ্ণ লবণতা আর মনের ভাজে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে তাকিয়ে থাকি পাচ নম্বর নিবেদিতা লেন এর মন্দিরের মত সেই বাড়ি থেকে বেরোনো দুদিকে লম্বা বেনি-ঝোলানো, চশমা পরা, ভীষণ সিরিয়াস সেই মেয়েটির দিকে-- যে পণ করেছে চশমার আড়ালে লুকিয়ে রাখবে তার অস্তিত্ব টুকু, আর সেই আপাত-গাম্ভীর্যের আড়ালে যার মন তা ভারী দুর্বল, ছোট দোলায় বড় বেশি চলকে ওঠে, ছোট দুঃখে বড় বেশি রক্ত ঝরায়। আর বায়স্কোপ এর মতই চোখে ভাসছে অগোছালো কিছু মুহূর্ত: হালকা হাসির কিম্বা গভীর ভাবনার, এলোমেলো হাটার কিম্বা চুপচাপ মৌন-মুখরতার, সাহচর্যের কিম্বা সঙ্গহীনতার। যারা ওই উড়িয়ে দেওয়া বুদবুদের মতই মুহূর্তেকের জন্যে এসেছিল আবার মিলিয়ে গেছে কোনো চিন্হ না রেখেই। হয়ত আমি ই ধরে রাখতে চাইনি। চাই ও না তাদের ফিরে পেতে, শুধু এমন কিছু মুহূর্তে, এমন কিছু রাতে তারা ফিরে আসে, জানিয়ে যায় তারা ছিল, তারা আজ ও আছে আমার মনের কোনো এক কোন জুড়ে। জানি না এ কেমন অনুভূতি, একদিকে এক অদ্ভূত পূর্ণতার স্বাদ, আবার কি এক না-পাওয়া, কি এক হারানোর লবনাক্ত ঘ্রাণ-- হঠাত যেন বুঝতে পারি, এখনো আমি ভাবতে পারি, অনুভব করতে পারি, এখনো আমি বেচে আছি, বড্ড বেশি করে বেচে আছি।

ভালো থেকো তোমরা, যাদের আজ আর হাত বাড়ালেই ছোওয়া যাবেনা,তবু যারা আছ আমার স্মৃতি জুড়ে। ভালো থেকো আমার ইস্কুল, যার কাছে গচ্ছিত আছে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু সময়। আর, ভালো থেকো উত্তর কলকাতা, তোমার ভেঙ্গে পড়া সৌধের সম্ভার নিয়ে, তোমার হারিয়ে যাওয়া সত্তা নিয়ে, তোমার অনাবাসী নাগরিক দের নিয়ে-- হারিয়ে যেও না, নইলে আমি কার কাছে ফিরে গিয়ে ফেরত চাইব আমার সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে?









শনিবার, ২ মে, ২০১৫

নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায়

আমি সেই বিরল প্রজতির একজন, যাদের কলকাতার গ্রীষ্ম ভারী প্রিয়। দিবা দ্বিপ্রহরের দারুণ অগ্নিবাণ, আপাদমস্তক স্বেদ-সিক্ত হয়ে বাড়ি ফেরার ক্লান্তি, বাড়ি ফিরেই ফ্রিজ এর ঠান্ডা খেয়ে সর্দি-গর্মী বাঁধানোর বাঙালীর চিরন্তন দুঃস্বপ্ন-- সব সত্বেও, আমার কলকাতার গ্রীষ্ম ভালো লাগে। এই সব দুঃখ ই ঘুচিয়ে দেয় দুপুরে শেষ পাতে আম নিয়ে পর্দা-ঢাকা ছায়াছন্ন ঘরে পাখার তলায় বসে গল্পের বই পড়ার নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব আলস্য, আর, কালবৈশাখী।

কালবৈশাখী যে কখনো দেখেনি তাকে বলে বোঝানো যাবে না সে কি অদ্ভূত সুন্দর। সারাদিনের ঘনঘটা নয়, বর্ষার একটানা রিমঝিম রুমঝুম বৃষ্টির ধারাপাত নয়, আকুল-ধারা শ্রাবণ ও নয়, কালবৈশাখী তার চকিত আকস্মিকতায়, তার বজ্রগর্ভ গাম্ভীর্যে, তার কুলপ্লাবী শান্তি-বর্ষণে যেন কবির কল্পনা থেকেই সটান উঠে আসা (ঠিক মোহিতলাল মজুমদার এর কল্পনা বলছিনা, সে কবিতা টা মনে না পড়ানোই বান্ছনীয়)। সারাদিনের তীব্র থেকে তীব্রতর রোদের রাজত্ব এক মুহূর্তে ধবংস করে যেমন হঠাত আকাশ-জোড়া সেই "কালো কোমল" ছায়া নেমে আসে, সেই ছায়া র দিকে চেয়ে কলকাতার রাস্তায় অফিস ফেরত ঘরমুখী জনতার হাটার বেগ যেমন হঠাত বেড়ে যায়, ঘরের বারান্দা থেকে ঝড়ের লোভনীয় রূপ আর সঙ্গে চা-সিঙাড়া র আকর্ষণ যেমন অনিবার্য হয়ে ওঠে, এমন করে গোটা শহরের দখল নিতে কে ই বা পারে! গড়িয়াহাট-হাতিবাগানের ফুটপাথ জুড়ে সাজ-সাজ রব, পসরা গুটিয়ে ত্রিপল খাটিয়ে প্রস্তুতির পালা শেষ হতে না হতেই রাস্তা জুড়ে প্রাচীনতার ধুলো পাক খেয়ে উঠতে থাকে ওপরে, অবহেলায় পড়ে থাকা ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা টাও পূবে হাওয়ার সওয়ার হয়ে হঠাত ডানা মেলে দেয়-- চোখ-বাঁচিয়ে ছুটে চলা পথচারী, হঠাত বেগ নেওয়া মিনিবাস আর পর্দা-ফেলতে ব্যস্ত অটো-যাত্রীদের কাপিয়ে দিয়ে এসে পড়ে ঝড়। কলকাতার রোজকার ধূসর সান্ধ্য আকাশ তখন অচেনা বেগনি রঙের, আর তার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাতায়াত করতে থাকে বিদ্যুতের এক-শো বাতির ঝলক, সঙ্গে বুক কাপানো গুরুগুরু মেঘ-গর্জন। বাড়িতে বাড়িতে জানলা বন্ধ করার তাড়া, আর আমার মত কিছু পাগল বারান্দায় এসে দাড়িয়ে থাকে দু-হাত মেলে, কখন প্রথম বৃষ্টির ফোটা এসে পড়বে সেই অপেক্ষায়। তারপর বৃষ্টি--গুনগুন "মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতাল" আর প্রথম বর্ষণ বুক পেতে নেওয়া তৃষিত মাটির বুক থেকে ওঠা সোঁদা একটা মন-কেমন-করা গন্ধ। তারপর মন-জুড়োনো একটা হাওয়ার রেশ, ভিজে বাড়ি ফেরার পরের উচ্ছসিত ব্যস্ততা, আর খুব শান্তির খুব আরামের একটা রাত। কাল আবার রোদ উঠবে, আবার গরমের ভারে ক্লান্ত হয়ে কলকাতা অপেক্ষা করবে সন্ধ্যের, আর একটা কালবৈশাখীর।

কলকাতা থেকে অনেক দূরে থাকি অনেক কাল হলো, এদেশে কালবৈশাখী নেই, এমনকি বর্ষা ও নেই বললেই চলে। শুধু আনন্দবাজারের পাতায় আর বাড়ির ফোনে খবর আসে, আর অমনি মনের মধ্যে ফিরে পাই সেই চেনা সন্ধ্যে টাকে, চেনা রং চেনা গন্ধ চেনা হাওয়ায় মোড়া চেনা সেই কালবৈশাখী কে। 

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...