বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭

শীতের হরিয়ানা

শীতের নরম রোদে ধুয়ে যাওয়া বারান্দায় বসে আছি, "শহর থেকে আরো অনেক দূরে"র এই ইউনিভার্সিটি আবাসনে। আজকে আমার স্বঘোষিত ছুটি, আজকে আমার আরাম করে এক কাপ চা হাতে নিয়ে শার্লক হোমস পড়ার বেলা। আজকে আমার শীতের ওম পোহাতে পোহাতে অক্ষরের উল বোনার দিন।
এখানকার শীত ভারী অন্যরকম, কলকাতার উদযাপনের শীতের থেকে বা দিল্লির চমকদার শীতের থেকে অনেকটাই আলাদা। সকালে ইউনিভার্সিটি যাবার পথে দেখি রোদের আল্তো ছোঁয়াচে ভেসে যায় ভোরের ঘনিয়ে আসা তুন্দ। রাস্তার পাশে বিছিয়ে থাকে নানা রঙের খেত : নরম সবুজের ধান, চষা মাটির বাদামি , গাঢ় সবুজ কপিপাতার বাহার, আর সব ছাপিয়ে উজ্জ্বল হলুদ সর্ষের বিস্ময়। মটরপাতার সবুজের ফাঁকে বীজের সন্ধানে উৎসুক ময়ূরের নীল ঝুঁটি ঝলসে ওঠে। কালো-হলুদের টুকটুক ভিড় হয়ে যায় সকালের কাজে যাওয়া মানুষের গায়ের ওমে। মেয়েদের হাতের যত্নে সাজানো টিফিনবাক্স, মাথার ঘুঙঘট্ এড়ানো উদাস চোখের চাওয়া, ছেলেদের হাতের বাহারি রিংটোনের মোবাইল, সব মিলিয়ে প্রতি টুকটুকে দেখি এক এক কলি গল্প জমে উঠছে, বাইরের এই কোহরার ই মতো। ক্যাম্পাস জোড়া মরশুমি ফুলের সাজানো সৌন্দর্য ছাপিয়ে যায় রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা আধো-ঘুমের এইসব সকাল গুলো।


এখানকার শীত ভারী অন্যরকম। অন্য জায়গার মতো শীতের জামায় রঙের বাহার খেলে না এখানে। স্বভাব-রঙ্গীন হরিয়ানভী পোশাকে বরং লাগে রঙের দৈন্য; পুরোনো মোটা শাল আর সোয়েটার এর মালিন্যে হঠাৎ চোখে পড়ে যায় বৈষম্যের কুৎসিত মুখ। আর দিগন্ত-জোড়া মাঠের মালিকদের গায়ের দামি মোটা জ্যাকেট-এ দামের অংশটুকু বাদ দিলে কিছুই পড়ে থাকে না। অন্যরকম শীতের অন্যরকম এই মানুষ গুলোকে দেখতে দেখতে কখন যেন অনেকগুলো শোনা-সত্যি হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এই নরম শীতের সকালটার ই মতো।
সারাদিন থাকি অন্য দুনিয়ায়, ক্যাম্পাস এর নকল বিদেশে। সকালের আলোয় উপচে ওঠা আমার ভীষণ প্রিয় অফিস রুমে বসে ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে দিব্যি কেটে যায় দিনটা। সবুজ মোলায়েম লন এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুবেশ ছটফটে ছাত্র-ছাত্রীদের দেখতে দেখতে ভুলে যাওয়া যায় হাউসকিপিং মেয়েটির চোখের নিচের দগদগে হয়ে থাকা গার্হস্থ্য ক্ষত, ভুলে থাকা যায় ক্যাম্পাসের বাইরের এই হরিয়ানা ও আমার ই দেশ। শীতের সুখী বেলা এলোমেলো হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যায় সব গভীর ভাবনা, পড়ে থাকে শুধু অনেকগুলো সুখী চুমুকের শেষে কফিকাপের তলানি টুকু। ছোট ঘর, ছোট চিন্তা, ছোট পরিসরে কেটে যাওয়া আমাদের জীবনের ই মতো, ফুরিয়ে আসে ছোট শীতের বেলা।
অন্যরকম শীত ফিরে আসে সন্ধ্যেয় ফেরার পথে। বাঁকানো শিঙের রাজস্থানি গরুর পাল নিয়ে গোঠে-ফেরা রাখাল থামিয়ে দেয় ন্যাশনাল হাইওয়ে এক এর দিল্লিমুখী গাড়ির-স্রোত। টকটকে লাল ডুবন্ত সূর্য কে পাশে রেখে বাদামি ক্ষেতের ওপর আঁকা হয়ে যায় নীলগাই এর সান্ধ্য সিলুয়েট। কালো রাস্তার বুক চিরে তীব্র বেগে চলতে থাকা গাড়ির শব্দে নেমে আসে হঠাৎ বৈরাগ্য। আরো একটা তীব্র শীতল, বুক-কাঁপানো শীতের রাত নেমে আস্তে থাকে চরাচরে। সারারাত ট্রাকের আনাগোনায় মুখর, রাস্তার পাশে ধাবায় ক্ষণিক বিরতিতে আগুন পোহানোর রাত। অন্যরকম রাত। ভারী সুন্দর, ভারী অন্ধকার। ঠিক, এই অন্যরকম দেশের মতো। আমার দেশের মতো।

মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭

তোমায় অনেকদিন হলো খুঁজছি, কোনো ঠিকানাই পাচ্ছিনা।কোথায় থাকো গো মেয়ে? কোন দেশে? সেখানে বুঝি বিকেলের এই পূবে হাওয়া পৌঁছয় না? সেখানে বুঝি ঘামে ভিজে যাওয়া শরীর জুড়িয়ে বড়ো বড়ো ফোঁটায়  নেমে আসে না হঠাৎ বৃষ্টি? আর সেই বৃষ্টিতে ছাতা নিয়েও কাকভেজা হয় না অন্যমন কোনো ইস্কুলফেরত মেয়ে? সেখানে বুঝি এপার ওপার বিছিয়ে থাকা ভরা বর্ষার গঙ্গা নেই, যার বুকে টিমটিমে আলো জ্বেলে সারারাত জেগে থাকে জেলে নৌকো রা? সেখানে বুঝি মেঘে মেঘে প্রতি ক্ষণে নতুন নতুন ছবি ফোটে না আকাশে? সেখানে বুঝি ভিজে সন্ধ্যের ঝালমুড়ি চা ফুচকা নেই? সেখানে বুঝি সারাদিনের একসুরে বৃষ্টি শুনতে শুনতে একটা গোটা উপন্যাস শেষ করার আলতো অলস মন খারাপ নেই? সেখানে বুঝি ইলিশ সর্ষে আর শেষপাতে রসগোল্লা নেই? সেখানে বুঝি অকারণ মনখারাপ হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো বিকেল নেই, কথার স্রোতে ভেসে যাওয়া রাত নেই ? সেখানে বুঝি....

বাড়ি ফিরবে কবে, মেয়ে?

মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭

আজান এবং

আমাদের বাড়ি ছিল রাজাবাজারের বেশ কাছে, জ্ঞান হওয়া থেকেই আজানের ডাকে ঘুম ভাঙার অভ্যেস ছিল। এখনো বেশ মনে পড়ে সেই ভোরের হাওয়ায় ভেসে আসা ডাক, আর তারপরে হালকা হয়ে যাওয়া ঘুমে মা কে জড়িয়ে ধরে মা-মা গন্ধে ডুবে যেতে যেতে আবার ঘুমিয়ে পড়ার অদ্ভুত তৃপ্তি। বড়ো হয়ে স্কুল এ পড়ার সময় হলো রাত জাগার অভ্যেস। কাজে-অকাজে রাত কাবার করে ভোর পাঁচটায় শুতে যেতাম, আর ভোরাই হাওয়ায় ভেসে আসত আজানের সুর, একটু একটু করে আলো ফুটিয়ে দিত আকাশে, সেই আলোর ফুলকি-র কুঁকড়ো র মত-- আর রাতজাগা ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিতাম ঘণ্টাকয়ের ছোট্ট ঘুমে। আজান মানে ছিল কি এক অচেনা রেশ, আজান মানে ছিল পবিত্র ভোরের শুরু। দিনের অন্য সময়ের নামাজ তো যেমন-তেমন, ভোরের আজান যেন কি এক অপার্থিবের কথা বলত। 
আমি শব্দ-দূষণের পক্ষে নই, আমি মাইকে রবীন্দ্রসংগীতের পক্ষে নই, আমি বাবা তারকনাথের যাত্রার জলসত্রে মাইকে টুনির-মা-র পক্ষে নই, আমি অনর্থক হর্ন আর ভোটের আগে দিনভর জনসভার পক্ষে নই। কিন্তু আমি ভোরের আজানের, মাঝরাতের সন্ধিপুজোর, ক্রিস্টমাস ইভে ক্যারোল এর পক্ষে। কেননা আমার দেশ আমায় ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছে এই সব কিছুকে নিয়ে বাঁচতে, সম্মান করতে। অথবা, আমার কাছে এই ছোট ছোট সুবিধে-অসুবিধে, ভালোলাগা-না লাগা নিয়ে বাঁচার এই চালচিত্র টাই আমার দেশ। 

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...