রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৫

ভরা আষাঢ় বঙ্গোপসাগরে
তোমার চোখে তখন ও বৈশাখ
বেলাভূমির পায়ের ছাপ বুঝি
ভুলেই গেছে কে দিয়েছিল ডাক

ডাক পাঠালে, মেঘ-থৈথৈ বেলা
তোমার বুকে ঢেউ-এরা উচ্ছল
~"সাগরপারে আবার দেখা হবে"~~
--পূবে হাওয়াই আমার সম্বল

এলাম তাই হাওয়ার-ই হাত ধরে
সকাল থেকে অপেক্ষার ক্ষণ
কোন ঢেউ-এতে তোমার ই নাম লেখা
কোন হাওয়াতে তোমার ই গুঞ্জন

এখন তোমার অকুল বিথার; দেহে
এখন তোমার সিক্ত লবণতা
এখন তোমার অনেক সাথী, নদী,
এখন কি আর ভাববে আমার কথা?

তোমার জন্যে  যে মন আনলাম
এই মোহনায় আলগোছে থাক পড়ে
তোমার-আমার গাঙ্গেয় আলাপ ও
রেখে এলাম তোমার অগোচরে ।।

শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৫

তোমার আহত চোখ, ভীরু হরিণীর অভিমান
বিন্দু বিন্দু সেঁচে তোলা তোমার অননুবিদ্ধ ঘ্রাণ
তোমার ব্যথার নীড়ে বড় কাছে পেয়েছি তোমায়
অকালবর্ষণে এস, ওগো পূরবীর মৃদু বায়...

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫

গাঙ্গেয়

ওর সঙ্গে আমার আলাপ লঞ্চ এ। হাওড়া-বাগবাজার সকাল নটার লঞ্চে রোজ দেখতাম, হালকা রঙের শাড়ি পরা, কালো কাপড়ের ব্যাগ হাতে, কেমন যেন ধূসর চেহারা। পুরনো দিনের ফ্রেম অলা চশমা চোখে, চশমা টা খুললে দেখতাম চোখ দুটি আশ্চর্য সুন্দর। লঞ্চের কেজো ভিড়ের মধ্যে ওর নির্বিকার শান্ত নদীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকা ওকে সবার থেকে অনেক আলাদা, অনেক দূরের করে দিত। ভালো লাগত। কথা বলতে ইচ্ছে হত খুব ই, পারতাম না। উত্তর কলকাতার এঁদ গলিতে এক সাহিত্য-পত্রিকার অফিসে চাকরি করি আর কবিতা লিখি, মেয়েদের সঙ্গে যেচে আলাপ করার সাধ্যি কই । 
তবু, আলাপ হয়েই গেল। কি এক কারণে লন্চ বন্ধ সেদিন, ভিড়ভাট্টায় দিশেহারা চোখদুটো হঠাত জড়তা কাটিয়ে দিল,  বাস এ যেতে যেতে কথাও হলো খানিক। নাম... না থাক, শুনলে চিনে ফেলতে পারেন-- ধরুন, ধারা। রথতলার দিকে থাকে, বছরখানেক আগে বাবা মারা গিয়েছেন, আর কলকাতা ইউনিভার্সিটি তে সংস্কৃত নিয়ে মাস্টার্স করছে। কথা হলো এই, তবে কথার বাইরেও, একটা আলাপ হয়ে গেল। এতটা আলাপ, যাতে পরের দিন ফোন এ আগামী শনিবার বাবুঘাট এ দেখা করার প্লান ও করে ফেললাম দুজনে। কখনো ভাবিনি কোনো মেয়ের সঙ্গে এরকম একলা দেখা করতে যাব, কিন্তু কেমন যেন সাবলীলভাবেই কথা হয়ে গেল, যেন ওকে কতদিন চিনি, যেন লজ্জার দূরত্ব থাকার কথাই  নয়!

সেদিনের প্রিন্সেপ ঘাট ভারী মনোরম। এক পশলা বৃষ্টির পর মেঘলা আকাশ আর পূবে হাওয়ায় সুন্দরী গঙ্গা। ছোট ছোট ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কচুরিপানার দলগুলো। হালকা গল্প চলছিল, টুকটাক। ধারা কাদম্বরী পড়ছে এখন, গল্পটা বলছিল। তপস্বিনী মহাশ্বেতা র পুণ্ডরীকের জন্যে তপস্যা, সেদিনের শান্ত গঙ্গা আর ধূসর শাড়ির বিষণ্ণ চোখের ধারা, সব মিলিয়ে কেমন একটা ঘোর লেগে গেল। কবিতার দুটো পংক্তি হঠাত ভেসে এলো মনে, এত তীব্রভাবে, যেন না লিখতে পারলে চলছে না। ধারার থেকে একটা কাগজ কলম চাইলাম।
"লিখবে?"
"কবিতা। এক্ষুনি লিখি, নইলে যদি ভুলে যাই?"
ধারার চোখ পলকে উজ্জ্বল, এক মনে দেখল আমার লেখা। তারপর চাইল। কলম নিয়ে কি যেন কাটাকুটি করে ফেরত দিল আমার খাতা। অবাক হয়ে দেখি, আমার কবিতা সামান্য কিছু শব্দবিন্যাস পাল্টে নতুন হয়ে গেছে, আরো সুন্দর, আরো মন-ছোঁওয়া। খুব হালকা লাগছিল, খুব খুশি। এক মুহূর্তে যেন খুব কাছাকাছি এসে গেছি দুজনে। কদিনের আলাপ পেরিয়ে আমরা যেন চির-সহচর হয়ে গেছি।
"এ কবিতাটা আমায় দেবে?"
"এ তো তোমার ই কবিতা, ধারা"
"না, দুজনের। দাও, আমি এই কবিতা গুলো আলাদা করে রেখে দেব। এগুলো শুধু আমাদের জন্যে, এগুলো তুমি ওই সব পত্রিকায় ছাপতে দিতে পারবে না। কেমন?"
"নষ্টনীড় এর চারু র খাতা? তা বেশ, তাই থাকুক"-- নিজেকে মনে হচ্ছিল খুব ধনী, যেন ধারা চাইলে আমি আমার সাম্রাজ্য টাই ওর পায়ে লুটিয়ে দিতে পারি। ছোট থেকে ডানপিটে দাদা আর তিরিক্ষে বাবার ভয়ে জড়োসড়, পৃথিবী র থেকে বাঁচতে শামুকের মত খোলে ঢুকে থাকা আমাকে ছোট্ট কথাগুলো যেন প্রথম ডানা মেলতে শেখালো। বুঝতেই পারছেন, গদ্যেও কবিতা করে ফেলছি সেদিনের কথা ভাবতে গিয়েই।


তারপর, প্রতিদিন সকালে লঞ্চঘাট থেকে দুশ-চল্লিশের স্ট্যান্ড অবধি টুকরো কথার স্রোত, আর শনিবারে প্রিন্সেপ ঘাট, আর একটি করে দ্বৈত কলমে লেখা কবিতা। আমি বদলে যাচ্ছিলাম। অফিসে বসের দিকে তাকিয়েও সৌজন্যের হাসির সাহস পাচ্ছিলাম, বাড়িতে দাদার কাছে মায়ের ভেঙ্গে যাওয়া চশমা মেরামতের জন্যে দরবার করতে কুন্ঠা হয়নি, রোজ রাতে বাড়ি ফিরে মায়ের সঙ্গে সিরিয়াল দেখা ছেড়ে মুদ্রারাক্ষস এর অনুবাদ নিয়ে বসছিলাম। যেন অন্য আমি, যে আমিটার স্বপ্ন দেখতেও আগে ভয় পেতাম। আর, শনিবারের কবিতা গুলো ও আরো বেশি ভালো হয়ে উঠছিল। এখন প্রথমে এসেই জায়গা খুঁজে বেঞ্চিতে বসে পরেই কাগজ কলম বার করি। মাথায় গুনগুন করতে থাকে কিছু লাইন, ধারা ও পাশ থেকে জায়গা মত শব্দ বলে দেয়,আধ ঘন্টার মধ্যে জন্ম নেয় আমাদের যৌথ সৃষ্টি। ধারা উদ্দীপ্ত আগ্রহে আবার পড়ে, তারপর অসীম মমতায় হাতব্যাগ এ ভরে নেয় পাতাটা। কি আনন্দ, কি অদভূত ঘোর তারপরের গোটা সময়টা জুড়ে থাকে। হাঁটি না, যেন ভেসে ভেসে ঘুরি ময়দানের দিকটা, ঘাসের মধ্যে মিশিয়ে দিই নিজেকে, ঝালমুড়ি খেতে গিয়ে লঙ্কা চিবিয়ে ফেলে ঝালে অস্থির ধারার মুখটা দেখি। বেঁচে থাকি ভীষণভাবে, যেমনটি কখনো বাঁচিনি। 
ধারাকে বলি, কবিতা লেখ না কেন সিরিয়াসলি? ধারা ওর স্বাভাবিক অন্যমনস্ক নির্বিকারতায় হাসে। 

সপ্তা পাঁচেক গেল। কিন্তু এবারে ভারী অস্থির লাগতে শুরু করলো আমার। প্রতি সপ্তায় ওই একটি কবিতা লিখি, লিখি মন উজাড় করেই, কিন্তু সে তো রয়ে যায় ধারার কাছে। আমাদের দুজনের যৌথ ফসল, সে কি দিনের আলোর মুখ দেখবে না কোনদিন ও? ভালো হয় কবিতাগুলো, ছবির মত, নদীর মত সুন্দর। শনিবারে বাড়ি ফিরে তারা তাড়া করে বেড়ায় আমাকে, প্রকাশের আকাঙ্ক্ষায়। আর, কেন জানিনা, বাকি সারা সপ্তাহে কবিতা আসেই না কলমে। শুধু পড়ি, ভাবি, আর অপেক্ষা করি শনিবারের।

পরের সপ্তাহে ধারা ব্যাগ খোলার আগেই বললাম, " ধারা আজকের কবিতাটা থাক না। সামনের মাসে একটা লিটল মাগাজিন থেকে লিখতে বলেছিল, দুজনের নামে পাঠিয়েই দিই নাহয়?"
"ছাপাবে?"-- আহত, আকুল ধারা।
"না, মানে, একটা ছাপাই ? বাকি গুলো তো রইলো ই শুধু দুজনের জন্যে? একবার বরং সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিই আমাদের অস্তিত্বটা?"
জেদী, একগুঁয়ে গলায় ধারা বলল "না।"
বলেই, ঢুকিয়ে রাখল কবিতাটা।
সুর কেটে গেল দিনটার। শ্রাবণ সন্ধ্যায় আকাশ ও ঘন কালো, কালো নদীর বুক, বিদ্যুতের ধমকানি--তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলাম। কেমন একটা লাগছিল, যেন না ফুরোনো গল্প, তান কেটে যাওয়া রাগিনী। চট করে খাতা নিয়ে বসলাম, লিখে ফেলতে হবে আজকের কবিতাটা। এভাবে বোকা জেদের কাছে হারিয়ে যেতে দেব না আমাদের সৃষ্টিকে। আর, ছাপা হয়ে গেলে ধারা ই তখন হয়ত খুশি হয়ে উঠবে, বুঝবে নিজের বোকামি।

কি আশ্চর্য, একটা লাইন ও মনে পড়ল না, এই কয়েক ঘন্টা আগে লেখা, এত প্রিয় কবিতাটার!


পরের শনিবারে কবিতা এলো, কিন্তু ভারী দায়সারা, ভারী অনিচ্ছুক। ধারা কবিতাটা রেখে দেবার পর চুপচাপ বসে রইলাম দুজনে। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল, আমরা আইস-ক্রিম পার্লারের কাঁচ দিয়ে দেখছিলাম বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া উত্তাল গঙ্গা। ধারা আজ একটা গেরুয়া শাড়ি পরেছিল, পাশে বসেও ওকেও ওই গঙ্গার মতই দূরের, ঝাপসা লাগছিল। অন্যমনে বলল, ওর থিসিস এর কাজ চলছে, এখন কদিন ইউনিভার্সিটি যাবেনা। অস্থির লাগছিল, ঝড়ের আগের শান্তি যেমন অস্থির। মনে হচ্ছিল কিছু যেন ঘটবে, যেন কোন অমোঘ পরিণতির টানে আমরা দুজন খড়কুটোর মত ভেসে চলেছি। 

সপ্তাহটা কাটল পাগলের মত। সকালে শার্ট ইস্ত্রী করতে ভুলে গেলাম, অফিসে চেকবুক হারিয়ে অপদস্থ হতে হলো সবার কাছে, বৌদি টাকা না নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ঠাট্টা করে বলল প্রেম করছ নাকি। নিজের মধ্যে নিজে কোনঠাসা হয়ে পড়ছিলাম। হতাশ, দিশেহারা দিন; দীর্ঘ, অসহ রাত্রি।

শনিবার সকাল থেকে বৃষ্টি, রাস্তায় জল ঠেলে উদ্ভ্রান্তের মত লঞ্চঘাটে পৌঁছে দেখি লঞ্চ বন্ধ, আর ঘাটের ব্রিজ এর ওপর একলাটি দাড়িয়ে আছে আকাশী শাড়ির ধারা। পাশে গিয়ে দাড়াতেই ফিরে তাকালো আমার দিকে, ছোট্ট একটু হেসে একটা কাগজ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "দেখো।"
চার লাইনের কবিতা। অন্ত্যমিল নেই, ছন্দ ও। শুধু ওই বর্ষার গঙ্গা আর ভিজে হাওয়ার মত, খুব নির্জন, খুব উদাস। এমন কবিতা আগে পড়িনি, লিখিনি তো বটেই! ভরা নদীর মত বুকটা ভরে গেল পূর্ণতায়, ধারার হাতটা চেপে ধরে বললাম, "এই কবিতাটা আমি নেবই ধারা, ইটা আমি তোমার নাম ছাপাবই। কত প্রশংসা পাবে তুমি দেখো, কত ভালো লাগবে। এটা দিতেই হবে তোমায়। " 
বিষণ্ণ হাসলো ধারা, "নেবেই?"
সাহস পেয়ে বললাম, "হ্যা, নেবই। আর, বাকিগুলোও নেব। সবকটা ছাপতে দেব, একটা সিরিজ এর মত করে। ভালো হবে না, বল?"
" বাকি? বাকি তো নেই"
"নেই? তোমার কাছে?"
"আমি নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি যে। নদীর দেওয়া কবিতা, নদীকেই দিয়ে দিয়েছি।"
"নদীতে? মজা করছ?"
দৃঢ় চোখ তুলে তাকালো ধারা। পাগলের মত হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিলাম আমার হাত। ওর কবিতাটা হাতে নিয়ে দৌড়ে চলে এলাম বাড়ি। আর কক্ষনো দেখা করব না ওর সঙ্গে। আমাদের সৃষ্টিকে কেমন করে মেরে ফেলতে পারল ও? এত অবলীলায়? এত নির্বিকার ভাবে?

আমার গল্প ফুরিয়ে এলো। ওর আসল নাম ছিল জাহ্নবী । চেনা লাগছে, না? আজকের কাগজের প্রথম পাতায় দেখে থাকবেন, প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে জলে ডুবে আত্মহত্যার খবরে নাম বেরিয়েছে। আর, ওর ব্যাগ থেকে পাওয়া গেছে পলিথিন প্যাকেট এ মোড়া, যত্ন করে রাখা সাতটি কবিতা। আমাদের দুজনের নাম লেখা: জাহ্নবী ও শান্তনু । 


স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...