বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০১৪

ফেরারী মন

একজন প্রশ্ন করেছিল: "ফিরে আসতে কেমন লাগে?" কেমন লাগে অনেক গুলো বছর পর সেই সব রাস্তা দিয়ে হাটতে যাদের অনেক পিছনে ফেলে তুমি চলে গেছ অন্য কোনখানে? কেমন লাগে আবার নিজেকে খুঁজে পেতে সেই ঘরের কোণে একদিন যেখানে ফেলে গিয়েছিলে অনেক স্বপ্নের আকিবুকি? 
দেড় বছর পর কলকাতার মাটি ছুতেই দমদমের ধুলি-ধুসরিত বাইপাস, গ্রীষ্ম-ক্লান্ত কাকুরগাছির মোড়, সকালের পুজোর আরতি-রত পাড়ার কালীমন্দির, সবাই জিগ্যেস করে উঠলো: কেমন লাগে?

ফিরলাম। তবু ফিরলাম কি? 

ক্ষণিক বিরতির এই এক মাসের কলকাতা-যাপন কে কি ফেরা বলে? যে ছোট ছোট স্মৃতি স্বপ্নের মত হয়ে জমে থাকে মনের গভীরে, একটা মাস সেই রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ কে বাস্তব বলে চিনে নিতে নিতেই তো চলে যাবার ডাক এসে পরে, আমার আর ফেরা হয় না। অবাক বিস্ময়ে শুধু দেখি কি অসীম আনুগত্যে আমার শহর তার সেই মরা হলুদ পথদীপের দৃষ্টি নিয়ে, তার সেই শতাব্দী-প্রাচীন গলি নিয়ে, তার ব্যস্ত রাজপথ তার নির্জন গঙ্গা নিয়ে আমার-ই, শুধু আমার-ই জন্যে বসে আছে; তবু ফেরা হয়না। আমার ফেলে যাওয়া ঘরের আনাচে কানাচে দেখি কি অসীম মমতায় গেথে রাখা আমার ই হাতের ছাপ, আমার কৈশোর, আমার দিনলিপি কেমন করে যেন থমকে রয়ে গেছে চার দেওয়ালের ঘেরে শুধু আমাকেই ফিরে পাবে বলে; তবু ফেরা হয়না। কোনো একলা বিকেলে আজ ও ঠিক তেমনি করেই হঠাত বর্ষণে স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে বাড়ির পাশের সেই বন্ধু কৃষ্ণচূড়া, হঠাত খুঁজে পাওয়া কলেজ-ডায়রির পাতায় এক লহমায় ফিরে আসে বুঝি বা অন্য কোনো জন্মের হারানো মুহূর্তরা, নেশা ধরানো একটা আবেগ, জড়িয়ে ধরতে চাওয়ার একটা আকুলতা--তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়...

হয়ত কোনদিন ই ফেরা হবে না। হয়ত বহতা পথের দাবি মিটিয়ে আর দেবার মত কিছুই পড়ে থাকবে না এই শহরটাকে। শুধু বারবার আসবে এই ফেরা-না-ফেরার দ্বন্দ্ব, ছুটে চলার ফাকে এক বুক অক্সিজেন ভরে নেওয়ার এই বিরতি, নিজেকে ফিরে পাবার নিজের মুখোমুখি এসে দাড়াবার এই ক্ষণ--শুধু দেখা পাওয়া শুধু ছুয়ে যাওয়া .. আর স্বপ্নে রোজ হানা দেবে সেই ফিরতে চাওয়ার স্বপ্ন টা-- শ্যামবাজারের ভিড় রাস্তায় সেই সান্ধ্য চায়ের কষাটে স্বাদটা হয়ে, কলেজ স্ট্রিট এর চেনা বই-অলার সেই অবাক চিনতে পারাটা হয়ে, অনেকদিন পর দেখে ছাত্রী-গর্বে গর্বিত প্রফেসর এর মুখটা হয়ে, গঙ্গার বুকের সেই মন কেমন করা ঢেউ এর দোলাটা হয়ে.... আর সেই ফিরে আসার দিন গুনতে গুনতে কখন যেন আরো, আরো প্রাচীন হয়ে যাবে আমার শহরটা ...




শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০১৪

হাওয়া বদল

শীতের শেষ দিন টা পেরিয়ে এলাম আজকেই (বোধ হয়) -- এবারের অতিরিক্ত লম্বা আর কনকনে ঠান্ডা শীত টা অবশেষে জায়গা ছেড়ে দিল বসন্তের প্রথম দিনটিকে। সকালে চলে যাবার আগের শেষ দীর্ঘ-নিশ্বাস এর মত উত্তুরে হাওয়া শেষমেষ ঝলমলে রোদ এর কাছে বেমালুম হেরে গিয়ে বেপাত্তা ই হয়ে গেল। আপেল গাছের পাতা-ঝরা ফাকা ডাল গুলো সাদা ফুলের সম্ভারে সেজে উঠেছে, আকাশের নীল এর তীব্রতার সামনে চোখ পাতা যায় না। জ্বলে যাওয়া ঘাসগুলোয়  এখানে সেখানে সবুজের ছোপ, গলফ কোর্স এর মাঠ জুড়ে কখন ছেয়ে গেছে একরাশ নীল ফুল। দিন বদলাচ্ছে। প্রতিদিন, একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে বয়েসের ভারে জীর্ণ অথচ চিরযৌবনা এই পৃথিবী টা।
ব্লু-বনেট
চিত্র-সৌজন্যে:  গুগল
বহতা নদীর মত চলতে চলতে জীবন ও বদলে যায়, বদলে দেয় আমায়। কখনো অজান্তেই আলোর বন্যায় ভেসে যায় মনের অন্দরমহল, কখনো মেঘ আর কুয়াশা পেরিয়ে দৃষ্টি চলে না ভাবীকাল এর দিকে। আর নিত্যদিনের এই বদলে যাওয়ার স্রোতে ভাসতে ভাসতে, উজান-ভাটির টানে দুলতে দুলতে কখন মনের মাটি তে এসে পড়ে নতুন পলির আস্তর, ঋদ্ধ হয়, পূর্ণ হয়। আর সব যাওয়া-আসা শেষে, সব স্রোত-অস্রোতের ঢেউ পেরিয়ে যখন ঘাটে এসে লাগে নৌকো, বুঝতে পারি, এত বদলের মধ্যেও কোথায় যেন রয়ে গেছে এক অপরিবর্তনীয়, যে ধরে রাখে, সংজ্ঞায়িত করে আমার অস্তিত্ব। শিকড়ে শিকড়ে যে মাটির সঞ্চার, সত্তার গভীরে যে চেতনার উন্মেষ। অনেক অনেক আলোকবর্ষ পেরিয়ে, এই বদলে যাওয়া পৃথিবী আর পাল্টানো সময়ের বুকে দাড়িয়েও জেগে থাকবে সেই চিরন্তন সত্য, শস্ত্রে ছেড়ে না অগ্নি দহে না যারে। ঋতু-বদলের এই প্রথম দিনে হঠাত কেমন করে মনে এসে বাজলো সেই অপরিবর্তনীয়ের ই সুর, নতুন করে ভালো লাগলো এই পাল্টে যাওয়া সময়, এই ভীষণ সজীব বেঁচে থাকা।

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...