শনিবার, ২ মে, ২০১৫

নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায়

আমি সেই বিরল প্রজতির একজন, যাদের কলকাতার গ্রীষ্ম ভারী প্রিয়। দিবা দ্বিপ্রহরের দারুণ অগ্নিবাণ, আপাদমস্তক স্বেদ-সিক্ত হয়ে বাড়ি ফেরার ক্লান্তি, বাড়ি ফিরেই ফ্রিজ এর ঠান্ডা খেয়ে সর্দি-গর্মী বাঁধানোর বাঙালীর চিরন্তন দুঃস্বপ্ন-- সব সত্বেও, আমার কলকাতার গ্রীষ্ম ভালো লাগে। এই সব দুঃখ ই ঘুচিয়ে দেয় দুপুরে শেষ পাতে আম নিয়ে পর্দা-ঢাকা ছায়াছন্ন ঘরে পাখার তলায় বসে গল্পের বই পড়ার নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব আলস্য, আর, কালবৈশাখী।

কালবৈশাখী যে কখনো দেখেনি তাকে বলে বোঝানো যাবে না সে কি অদ্ভূত সুন্দর। সারাদিনের ঘনঘটা নয়, বর্ষার একটানা রিমঝিম রুমঝুম বৃষ্টির ধারাপাত নয়, আকুল-ধারা শ্রাবণ ও নয়, কালবৈশাখী তার চকিত আকস্মিকতায়, তার বজ্রগর্ভ গাম্ভীর্যে, তার কুলপ্লাবী শান্তি-বর্ষণে যেন কবির কল্পনা থেকেই সটান উঠে আসা (ঠিক মোহিতলাল মজুমদার এর কল্পনা বলছিনা, সে কবিতা টা মনে না পড়ানোই বান্ছনীয়)। সারাদিনের তীব্র থেকে তীব্রতর রোদের রাজত্ব এক মুহূর্তে ধবংস করে যেমন হঠাত আকাশ-জোড়া সেই "কালো কোমল" ছায়া নেমে আসে, সেই ছায়া র দিকে চেয়ে কলকাতার রাস্তায় অফিস ফেরত ঘরমুখী জনতার হাটার বেগ যেমন হঠাত বেড়ে যায়, ঘরের বারান্দা থেকে ঝড়ের লোভনীয় রূপ আর সঙ্গে চা-সিঙাড়া র আকর্ষণ যেমন অনিবার্য হয়ে ওঠে, এমন করে গোটা শহরের দখল নিতে কে ই বা পারে! গড়িয়াহাট-হাতিবাগানের ফুটপাথ জুড়ে সাজ-সাজ রব, পসরা গুটিয়ে ত্রিপল খাটিয়ে প্রস্তুতির পালা শেষ হতে না হতেই রাস্তা জুড়ে প্রাচীনতার ধুলো পাক খেয়ে উঠতে থাকে ওপরে, অবহেলায় পড়ে থাকা ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা টাও পূবে হাওয়ার সওয়ার হয়ে হঠাত ডানা মেলে দেয়-- চোখ-বাঁচিয়ে ছুটে চলা পথচারী, হঠাত বেগ নেওয়া মিনিবাস আর পর্দা-ফেলতে ব্যস্ত অটো-যাত্রীদের কাপিয়ে দিয়ে এসে পড়ে ঝড়। কলকাতার রোজকার ধূসর সান্ধ্য আকাশ তখন অচেনা বেগনি রঙের, আর তার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাতায়াত করতে থাকে বিদ্যুতের এক-শো বাতির ঝলক, সঙ্গে বুক কাপানো গুরুগুরু মেঘ-গর্জন। বাড়িতে বাড়িতে জানলা বন্ধ করার তাড়া, আর আমার মত কিছু পাগল বারান্দায় এসে দাড়িয়ে থাকে দু-হাত মেলে, কখন প্রথম বৃষ্টির ফোটা এসে পড়বে সেই অপেক্ষায়। তারপর বৃষ্টি--গুনগুন "মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতাল" আর প্রথম বর্ষণ বুক পেতে নেওয়া তৃষিত মাটির বুক থেকে ওঠা সোঁদা একটা মন-কেমন-করা গন্ধ। তারপর মন-জুড়োনো একটা হাওয়ার রেশ, ভিজে বাড়ি ফেরার পরের উচ্ছসিত ব্যস্ততা, আর খুব শান্তির খুব আরামের একটা রাত। কাল আবার রোদ উঠবে, আবার গরমের ভারে ক্লান্ত হয়ে কলকাতা অপেক্ষা করবে সন্ধ্যের, আর একটা কালবৈশাখীর।

কলকাতা থেকে অনেক দূরে থাকি অনেক কাল হলো, এদেশে কালবৈশাখী নেই, এমনকি বর্ষা ও নেই বললেই চলে। শুধু আনন্দবাজারের পাতায় আর বাড়ির ফোনে খবর আসে, আর অমনি মনের মধ্যে ফিরে পাই সেই চেনা সন্ধ্যে টাকে, চেনা রং চেনা গন্ধ চেনা হাওয়ায় মোড়া চেনা সেই কালবৈশাখী কে। 

৩টি মন্তব্য:

  1. কালবৈশাখীর এমন একটা আশ্বাস দিলেন | "কোনো মন্তব্য নেই" দেখে ভালো লাগলো না | আমিও বহুদিন স্বাদ পাইনি | শুধুমাত্র ধুলোর ঝড় মানে "আঁধি" বড্ড শুকনো | এক্কেবারে নীরস | আসার চেয়ে না আসলেই যেন বেশি ভালো | কালবৈশাখীর মত বাঙালিয়ানা নেই |

    উত্তরমুছুন
  2. প্রখর তপন দগ্ধ দিবস
    তীব্র দহন জ্বালা ,
    এক লহমায় দাও যে ভুলায়ে
    শান্তির বারি ঢালা ।
    এসো এসো তুমি হে কালবৈশাখী
    বসুধারে কারো সিক্ত ,
    মন খুলে আজি গেয়ে যাবো গান
    মন হয়ে যাবে তৃপ্ত ॥

    উত্তরমুছুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...