সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১২

বিদায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

মহানবমীর সুপ্রভাতে কলকাতা যখন জেগে উঠছে আরো একটা সুন্দর পুজোর দিনে, আমার মতন প্রবাসী কিছু মন যখন আকুল আঁখি পেতে জেগে আছে ফেসবুকের পাতায় কলকাতার পুজোর নতুন "updates" পেতে, তখন ই হঠাত এলো খবর টা: চলে গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। হঠাত যেন শেষ হয়ে গেল একটা যুগ--আমার বড় হয়ে ওঠার সেই সময় টা। সেই লেখক, যার কাকাবাবু পড়ে শুরু হত পুজো গুলো, যার প্রথম আলো সেই সময় বারবার পড়েও পুরনো হয়না, যার পূর্ব-পশ্চিম প্রথম চিনিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তমাখা অধ্যায়, যার এক একটা কবিতার পংক্তিতে আটকা থেকেছে আমার কত না গুনগুনিয়ে-ওঠা-ভর--তিনি আর নেই। অপ্রত্যাশিত খবর টায় যেন কি এক ধুসর ম্লানিমা ছিল, মলিন হয়ে গেল পুজো-পুজো গন্ধ টা।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না থাকলে কেমন হত আমার বড় হয়ে ওঠা? প্রথম পড়তে শিখেই সন্তু র সঙ্গে সঙ্গে শিখে নেওয়া হত না কনিষ্ক র ইতিহাস বা হায়রগ্লিফিচ্স এর মানে; ক্লাস নাইন এ বই এর ফাকে রেখে ডুব দেওয়া হত না নীললোহিতের দিক-শূন্যপুরের সন্ধানে; জানা ই হত না অদ্ভূত যে মন-খারাপ গুলো ছেয়ে যেত হঠাত হঠাত, তাদের মানে। এখনো মনে আছে সেই সময় প্রথম পড়ার সেই দিনগুলো--একেবারে বাস্তব-জ্ঞান শুন্য হয়ে সেই কবেকার কলকাতা শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর অনুভব--নবজাগরণের কলকাতা; যা ভারতের ইতিহাসে এতটা তাত্পর্য্য পূর্ণ একটা অধ্যায়, আর কেউ কি এমন করে ধরে রাখতে পেরেছেন কল্পনা-ইতিহাসের মিশেলে এমন সুন্দর করে? সুনীল গান্গুলি র হাত ধরে প্রথম পাড়ি  দেওয়া "আধুনিক কবিতা" নামক ভীতিপ্রদ রাজ্যে--রবীন্দ্র-ছায়া পেরিয়ে অন্য কবিতার গুণগ্রাহী হওয়া টা আমার কাছে বেশ কঠিন ছিল, আছেও--তবে সুনীল এর ঝরঝরে অনায়াস পংক্তি গুলি অর্থ না বুঝেও ভালো লেগে যেত, মন ছুয়ে যেত। তারপর পরলাম পূর্ব-পশ্চিম--আরেক মহা-মূল্যবান রচনা, আমার এপার বাংলার দৃষ্টি তে প্রথম দেখতে পেলাম ওপারের ছবি, প্রথম জানা মুক্তি-যুদ্ধের মানে। এ ছাড়া ভ্রমন-কাহিনী তাই বা এমন সরস এমন সুন্দর করে কে লিখতে পেরেছে, এ দেশে আসার আগে এ দেশ কে অল্প-সল্প চিনলাম ও সেই সব ভ্রমন-কাহিনী পড়েই (অবশ্য সে চেনা বিশেষ কাজে আসেনি, এক ভবঘুরে কবি র দৃষ্টি তে সত্তরের আমেরিকা আর এক ভালোমানুষ ছাত্রীর চোখে আজকের এ দেশ একেবারেই এক রকম নয়)।   
আর ছোট গল্প। সত্যজিত এর পর বাংলা ছোটগল্প আর কারো হাতেই এত সার্থকতা পায়নি। ছোটদের বড় দের সব্বার জন্যে রয়েছে সেই ভান্ডার; নানান স্বাদের নানান বিষয়ের, ধরা পড়ে তার জানার পরিধি আর লেখার বিস্তার, জানান দেয় তার বৈচিত্র।
স্বীকৃতি পেয়েছেন কিছু, অনেক নিন্দা আর বদনাম কুরনোর পাশাপাশি পেয়েছেন অশেষ ভালবাসা ও। পাওনা ছিল আরো অনেক কিছুই, হয়ত বাঙালি বলেই যে সম্মান অধরা থেকে গেল। হয়ত শেষ স্বীকৃতি দিয়ে উঠতে পারবে না কৃপণ বাঙালি। তবু আমার মত আরো অনেকের ই মনে চিরদিনের হয়ে থেকে যাবেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী সুনীল, আর থেকে যাবে আমার কাকাবাবু সমগ্রের পাতায় তার হাতের লেখায় আমার নাম টা। মৃত্যুর কাছে কাকাবাবু হেরে গেলেন বটে, কিন্তু সব হার ই তো শেষ কথা নয় ...


২টি মন্তব্য:

  1. সুন্দর লেখা স্বাগতা। কবিতা যদিও একেবারেই বুঝিনা, তবু সুনীলের কবিতা পড়েছি। না বুঝেই। ঠিকই বলেছ তুমি, সব হারই শেষ কথা নয়।

    ভালো লাগল।

    উত্তরমুছুন
  2. khub abeg probon hye porechilam khobor ta shune..amar bhishon priyo lekhok, hoyto manush o..

    উত্তরমুছুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...