শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৩

আমাদের দশ দিনের স্পিতি সফরে ছিতকুল ছিল দুদিনের বিরাম। ইচ্ছে ছিল দুচোখ ভরে রেখে দেবার, মনের তন্ত্রীতে বেঁধে নেওয়ার ভারত-তিব্বত সীমানার শেষ গ্রামটি কে। চিনলাম  ছিতকুলকে, কিন্তু অপ্রত্যাশিতের পথ ধরে। আজকের স্পিতি-যাপনে ফিরে দেখি সেই অন্য স্বাদের, অন্যরকম  ছিতকুল।

দিন ৩: ছিতকুল 

স্নিগ্ধ শীতল অফিসে বসে আছো তুমি, মুঠোফোন ছাড়া তোমার এক মুহূর্ত কাটে না। জানলার বাইরে আকাশে রঙের পর রং জমে ওঠে, ধুয়ে যায়, তুমি ফিরেও চাও না। তুমি এস ছিতকুলে, শিখে নাও বেঁচে থাকা কাকে বলে, জেনে নাও নিজেকে। অন্তর্জাল কই, তোমার মুঠোফোন কথা বলার যোগাযোগ টুকুও দেবে না তোমায়; উষ্ণ জলের আকুতি তোমার থামিয়ে দিয়ে মাঝ-স্নানে দপ করে নিভে যাবে আলো -- আর শহুরে বিলাসিতায় চিরাভ্যস্ত তুমি যখন এইসব "অসুবিধায়" বিপন্ন হয়ে উঠবে, তখন ই তোমার সব অভিযোগ ঘুচিয়ে জানলার ফ্রেমে ভাস্বর হয়ে উঠবে হিমালয়। তোমার স্পিতি-যাত্রার প্রথম পাঠশালা ছিতকুল, তোমার পথের প্রথম তিলক ছিতকুল। 

কি করবে তাহলে তুমি ছিটকুলে? সকালে উঠে হয়তো ভাবছো মেঘলা দিন, কিন্তু তাই বলে পর্দা টেনে দিয়ো না যেন। হঠাৎ কোন ফাঁকে হয়তো চরাচরব্যাপী পাহাড় রাঙিয়ে উঠবে সূর্য, ওপাড়ের মানুষের-স্পর্শ-না-পাওয়া পাহাড়ের নিবিড় দেওদার-পাইনের বন ঝলমল করে উঠবে, দূরে বসপার তীর ধরে এঁকেবেঁকে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া ধুলোপথ বেয়ে পেরিয়ে যাবে কোনো আর্মি-ট্রাক, তার চলার ধূলোটুকু মিলিয়ে যেতে না যেতে আবার সেই নিঝঝুম ঝিঁ-ঝিঁ ডাক, আবার সেই অবিরাম ঝর্ণার কুলকুল, আবার সেই খাদের গভীরে বয়ে চলা বসপার মন্দ্রিত ধ্বনি। পায়ে পায়ে নেমে এস বসপার পাড়ে, মন ভরে নাও বসপার মাতোয়ারা উল্লাসে, তার গা বেয়ে উঠে যাওয়া পাইনের বনের বুক চিরে বয়ে যাওয়া হাওয়ার ব্যাকুল নিঃশ্বাসে। ভেজা শীত নিয়ে সেই হাওয়া তোমারো মুখে, চুলে চুপিচুপি আল্পনা এঁকে দিক। চুপ করে বসে থেকো তুমি, কবেই বা এমন বসেছো চুপ করে? কখন যেন তোমার মনের ভেতরের কোলাহল ও শান্ত হয়ে যাবে, কখন যেন এক সুরে তোমার মনও বেজে উঠবে। কেমন এক নিবিড় অচ্ছেদ্যতায় তুমি জড়িয়ে যাবে এই নিতান্ত একলা, নিতান্ত অমিশুক ছিতকুল এর সঙ্গে।

অমিশুক বৈকি ছিতকুল। রাতে পৌঁছেই তো তুমি শুনতে পেয়েছো ঢোল আর কাঁসরের আওয়াজ। সকালে চা দিতে এসে অক্ষয় ভাইয়া তো বলেও গেছে যে ছিতকুল এর অধিষ্ঠাত্রী দেবীর স্বামী সাংলার কামরু ফোর্টের মন্দির থেকে পত্নী-সমাগমে এসেছেন, তাই গ্রাম এ ভারী ধূম এই চারদিন। সেই মেলায় কিন্তু তোমার নিমন্ত্রণ নেই, তুমি যে বহিরাগত। মন্দির চত্বরে ফুলের মতো নতুন জামা পরা শিশুর মেলায় তোমার প্রশ্নের জবাব পাবে না তুমি, তুমি যে বহিরাগত। সকালে হোটেলের বারান্দা থেকে দেবতাদের ডুলি নিয়ে শোভাযাত্রা দেখে থমকে যাবে তুমি, কিন্তু প্রাণপণে বাঁধন ছিঁড়তে চাওয়া সাদা ছাগলটাকে যখন হোটেলের ঠিক পিছনে গ্রামসীমা-নির্দেশক পাথরে নিয়ে এসে তামার থালায় ধূপের আবিষ্ট গন্ধে ওরা বুঁদ করে দেবে, তোমাকে তখন চলে যেতে হবে অন্দরে, তুমি যে বহিরাগত। তোমার ঠাঁই হেথা নয়, অন্য কোথা , অন্য কোনোখানে।
তুমি অভিমান করবে, আর সব হিমাচলী গ্রামের স্বাভাবিক উষ্ণতা না পেয়ে তোমার বুঝি দুঃখ ও হবে। কিন্তু তার ও পরে, যখন গ্রামপথের কাদা পেরিয়ে তুমি হোটেলে ফিরবে, প্রবল শীতের মধ্যে লেপের ওম নিতে নিতে যখন বুঝতে পারবে প্রতিটি বাড়ির মাথায় স্তূপ করে রাখা কাঠকুটোর মানে, যখন বাঙালী হোটেলের হাওড়ার ছেলেটি তোমায় শোনাবে গত এপ্রিলে ভাল্লুক আর স্নো-লেপার্ড দেখার রোমহর্ষক গল্প, তখন একটু একটু করে তুমি বুঝতে পারবে ছিতকুল এর অভিমান। যে দেশ এর রক্ষার জন্যে সৈন্য পাহারায় সারা বছর জেগে থাকে ছিতকুল, কিই বা দিয়েছে সেই দেশ তাকে। তাই কিছু উদগ্রীব পর্যটকের বেমানান কৌতূহলে সে যদি পসরা না ই সাজায় তার নিজস্ব সংস্কৃতির, নিজের দেবতার, তাকে কি সত্যি ই দোষ দেওয়া যায়? তাই শখের পর্যটক তুমি, চলে যেও বসপার ধারে, ঘুরে এস সাংলার প্রধান বাজারে, ইন্দো-তিব্বতী সীমার সদাসতর্ক জওয়ানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এস, কিংবা বাতসেরি গ্রামের কাঠের মন্দির দেখে এস বরং। ছিতকুল হয়ে থাক দূর থেকে সুন্দর, কিন্তু দুর্ভেদ্য কুহেলিকার মতন দুর্জ্ঞএয়










কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...