শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮

স্পিতি-যাপন : পর্ব ২

আমাদের দশ দিনের স্পিতি-সফর যেন দশ রঙে ভাস্বর। এই বেরঙের দুনিয়ায় যাতে তারা হারিয়ে না যায়, তাই এই ধরে রাখতে চাওয়া আমার স্পিতি-যাপন। 


দিন ২- নারকান্দা-সাংলা-ছিতকুল 

স্পিতির পথে যতি নেই, ফেরা নেই, আছে শুধু সামনের দিকে চলা আর চলা।  এ যাত্রার নিয়ম ই তাই, ফিরে তাকানো যে বারণ এ পথে। নারকান্দা থেকে  আজ যাত্রা কিন্নর-দেশ। আমাদের সময় সীমিত, তাই সারাহান কে পাশ কাটিয়ে সোজা পৌঁছবো বসপার তীরে ভারতের শেষ গ্রাম ছিতকুল। ফেলে এলাম সদ্য ঘুম-ভাঙা নারকান্দা, পরে কোনোদিন হয়তো আবার আসবো, কথা দিয়ে। 
পথে রামপুর-বুশহর থেকে সঙ্গ নিলো শতদ্রু। গৈরিক, গম্ভীর, বর্ষাস্ফীত, সুনিশ্চিত পুরুষালি শতদ্রু। পঞ্চনদীর বিলিতি নামকরণে আমার সবচেয়ে আপত্তি এই নদ টিকে সাতলুজ নাম দেওয়ায়। এমন কুয়াশার ওম-জড়ানো পাহাড়, কালো পিচের নয়নাভিরাম রাস্তা, আধো-ঘুমে পাহাড়ি গন্ধমাখা জনপদ জখরি, জেওরি, সুনগর, আর বাঁকে বাঁকে দেবালয় পেরিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর নাম  কখনো সাতলুজ হতে পারে?! 

টাপরি আমাদের পরিচয় করলো প্রথম পাহাড়ি স্বাদের সঙ্গে। পথের পাশের ছোট্ট কিন্তু ভারী ছিমছাম দোকানে হিমাচলী থালি। উত্তর-ভারতীয় গুরু-ভোজন নয়, সহজিয়া দাল-রাজমা-কড়ি-চাওল এর আত্মীয়তার সুর আপন করে নিল আমাদের সন্দিগ্ধ বাঙালি রসনা। হিমাচলী কড়ি আর কিন্নরী গানের যুগল আমাদের আরো একটু কাছে এনে দিলো পথের। এ পথ তো এমন ই, আগল ভাঙার, হৃদয় দেওয়ার উদযাপন। যত্নে বাঁধা সীমার থেকে বাইরে ধুলো-কাদার পৃথিবীতে এসে দাঁড়ানোর আহবান। 

জেওরি-চুলিঙ-ওয়াংটু-কার্চম -- একের পর এক বিভিন্ন মাপের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। খরস্রোত শতদ্রু আলোয় ভরিয়ে তুলছে পাহাড় কে। কার্চম এ শতদ্রু কে ছেড়ে ধরলাম বসপার পথ। নীল আকাশ, বর্ষার আবিল বসপা, আর হঠাৎ রুক্ষ হয়ে যাওয়া পাহাড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত খারাপ হতে থাকলো রাস্তা। কোথাও তীক্ষ্ন বাঁকের রুদ্ধশ্বাস, কোথাও পাহাড় ফাটিয়ে তৈরী রাস্তার ওপর ঝুলে থাকা  পাথরের  ছাদ, কোথাও বা হঠাৎ পথ করে নিয়েছে পাহাড়ের বুক চিরে বোবা টানেল। চড়াই-উতরাই বেয়ে, বসপাকে কখনো পাশে কখনো নিচে রেখে আমরা যখন সাংলায় পৌঁছলাম, আকাশে তখন মেঘের সাজ। 

কিন্নর বাঙালির প্রিয় গ্রীষ্ম-গন্তব্য, সাংলায় ঢুকতে না ঢুকতে চোখে পড়লো বাঙালি হোটেল। পাহাড়ের গা জুড়ে ছড়ানো শহর সাংলা, শহরের আকাশসীমায় দেখা যায় প্রাচীন কামরু ফোর্ট। হিমাচলী কাঠ-কুহনি গঠনকলার অনবদ্য ছাপ। দীর্ঘ সোপানপথে আলাপ হয়ে গেলো হিমাচলী জীবনের সঙ্গে, কিন্নরী আপেল আর এপ্রিকট বাগানের সঙ্গেও। জুলাই শেষের আপেলবন লাল-সবুজে মেশামেশি-- সবুজ, সোনালী, লাল আপেল অপেক্ষায় আছে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার, আর তাদের জন্যে অপেক্ষায় আছে কাঠ-পাথরের বাড়িগুলোতে থাকা ভীষণ পরিশ্রমী কিছু মানুষ। কোথাও বানর বা অত্যুৎসাহী মানুষের নাগাল থেকে বাঁচাতে গাছগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে সাদা বা সবুজ জালে, কোথাও আলতো আড়ালে দোল খাচ্ছে সুবিখ্যাত কিন্নরী আপেল। 

সাংলা পেরোতেই নিচে বসপার তীর ঘেঁষে ছবির মতো সুন্দর বাতসেরি গ্রাম। কাল আসবো কথা দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম, কারণ ততক্ষনে আকাশ ঢেকে দিয়েছে বজ্রগম্ভীর মেঘ, আর ফোঁটায় ফোঁটায় এসে পড়েছে পাহাড়ি বৃষ্টি। আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি নির্জন পাইন-পাহাড়, পথের ওপর নেমে আসা স্ফটিক-স্বচ্ছ ঝর্ণা, ছবির মতো সুন্দর রকছম গ্রাম এবং মূর্তিমান অসঙ্গতির মতো সীমান্ত-সীমার চেকপোস্ট। আর অবশেষে গাড়ি হঠাৎ থেমে গেল তেমন ই এক পথে এসে পড়া ঝোরার সামনেটিতে। কোথায় হোটেল? সামনে তো মরকত-সবুজ ঘাস আলো করে ফুটে আছে গোছায় গোছায় নাম না জানা ঘাসফুল, কুলকুল করে ঝাঁপিয়ে চলেছে সাদা ফেনায় ফেনিল ঝোরা, যেদিকে দুচোখ যায় আবছা মেঘের বর্ডার-দেওয়া পাহাড়, পাহাড়, আরো পাহাড়। সেই ছাইরঙা মেঘ, বাদামি-সবুজ পাহাড়, আর সবুজ ঘাসের গায়ে দিগন্তসীমায় আঁকা ছোট্ট একটি দোতলা বাড়ি -- আমাদের ছিতকুলের দুদিনের আশ্রয় Wanderers' Nest. গ্রামের সীমানায়, পাহাড়ের কোলে ছবির মতো হোটেল টি, একপাশে আদিগন্ত সবুজ চারণভূমি, অন্যদিকে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি আর মন্দির সমেত বিছিয়ে আছে ভারত-তিব্বত সীমানার শেষ গ্রাম ছিতকুল। 








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...