শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮

স্পিতি-যাপন : পর্ব ১

স্পিতি থেকে ফিরে এসেছি এক সপ্তাহ হল। দশ দিনের যাত্রা শেষে এখন আবার ধোঁয়াশা-খিন্ন দিল্লি, ধূলি-মলিন সোনিপত। এই দৈনন্দিনতার রাজ্যে বুঝি ঠাঁই নেই সেই অলীক দশ-দিনের, সেই তীব্র স্বচ্ছ নীল-এর, সেই নানা-রঙের পাথরের ক্যানভাস এ অপরূপ সূর্যাস্তের, সেই অবিরল একাকিত্বের, অনাবিল দিবাস্বপ্নের। তাই স্মৃতির কুয়াশা ঢেকে ফেলার আগেই লিখে রাখি সেই দশ-দিনের গল্প। ধরা থাক কিছু মুহূর্ত, কিছু অনুভব, কিছু বা অলীক ভালোলাগা। আমার স্পিতি-যাপন।

দিন ১- দিল্লি-নারকান্দা 

বছর দুই হল ছোটবেলার হাওড়া স্টেশনের জায়গাটা নিয়েছে কাশ্মীরি গেট এর আই. এস. বি. টি. । হকারের হৈচৈ, ব্যাগ-কাঁধে দূরাগত দৃষ্টির যাত্রী, এক-হাত লালচুড়ির মুগ্ধনয়না নববধূ, চা-কফি-ইডলির ক্যান্টিন-- সব মিলিয়ে মন উড়ু-উড়ু একটা ব্যাপার। সেখান থেকে যাত্রা শুরু। হিমাচল পরিবহণের সুদৃশ্য হিমসুতা বাস-- ঘুম আসতে না আসতে টের পাই কখন চলার পথের ছন্দ বদলে গেছে; বাঁকে বাঁকে কখন আমরা পৌঁছে গেছি পাহাড়ে। রাতের অবয়ব ফুটে ওঠে পাহাড়ি গাছে, এলোমেলো ফুটে থাকা পাহাড়ি গঞ্জের আলোয়, পরওয়ানূ পেরোতে না পেরোতে আধো আলোয় ডানা মেলে পাহাড়ি ভোর।
গ্রীষ্মের সিমলা ঠিক যেন পাহাড়ে-সাম্রাজ্য-পাতা-দিল্লি কি চন্ডিগড়, তাই সিমলা নয়, আমরা থামবো নারকান্দায়। ভোরের নির্জন সিমলা থেকে শুধু নিলাম প্রথম পাহাড়ি গন্ধ, আর আমাদের আগামী দশদিনের বাহন সমেত সারথী দিলিপ জি কে। 
সিমলার কাছে হলেও নারকান্দা নির্জন ছিমছাম শহর। পাহাড়ের মাথায় হিমাচলী সরকারের হোটেল হাটু থেকে সাফসুতরো দিনে দেখা যায় ধৌলাধরের ঢেউ-এর পর ঢেউ। কিন্তু এই শেষ জুলাই এর বর্ষার নারকান্দা মানে মন-কেমন করা সবুজ, বুড়ো পাইনের আলতো দীর্ঘশ্বাস, মেঘ-কুয়াশার নরম জল রং। বর্ষার নারকান্দা মানে হঠাৎ চমকে দেখা বেণী দোলানো এক কিশোরী-- মনে পড়ে যাওয়া তার কিছু না-পাওয়ার গল্প, কিছু আঁসুর ইতিহাস। ওই যে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাওয়া পান্না-ঘাসের পথ, যে হারিয়ে গেছে শ্যাওলা-নরম পাইনের ছায়ায় ছায়ায়, তার ই কোন আড়ালে যেন সেই মেয়ে আজ ও খুঁজে চলে তার ছলকে পড়া কিছুটা মন, কয়েক টুকরো ভালোলাগা। যত কিছু হারিয়েছি বড়ো হয়ে ওঠার বাঁকে বাঁকে, সব মনে এসে ভিড় করে, নতুন করে ভাবায়, নতুন করে বর্ষার জলে ভরে ওঠে ক্ষত; নতুন ব্যাথায় নতুন অনুভবে নতুন রোমাঞ্চে জেগে উঠি, বেঁচে উঠি। বর্ষার নারকান্দা তার ভেজা শীত নিয়ে, তার পুরোনো কাঠের বাংলো নিয়ে, তার বহুযুগের ওপার হতে আসা মন-কেমনের  দুপুর নিয়ে কূলে কূলে উপচে ওঠে যেন।

নারকান্দার বিকেল-বিলাস কাছাকাছির দুটি দ্রষ্টব্য: হাটু পীক আর তান্নু জুব্বার লেক। চরাচর-ব্যাপী কুয়াশায় হাটু পীকের রাস্তা তার সরু পায়েচলা প্রস্থ আর তীক্ষ্ন বাঁক নিয়ে ভয়ের কাঁপন ধরিয়ে দিলো আমাদের শহুরে শিরায়-- আমাদের স্পিতি পথ-যাত্রার হলো শুভ-উদ্বোধন। 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...