বুধবার, ২০ মে, ২০১৫

এমন কেন সত্যি হয়না আহা ~~ পর্ব ১: রাধা

(সাহিত্য কিম্বা ইতিহাসে কত না চরিত্র কেন জানি খুব কাছে চলে আসে মনের। কখনো বুঝি মনে হয়, কেমন হত যদি তাদের জীবন তা অন্যরকম হত? তাদের দুঃখ গুলো না ই বা থাকত এমন করে?
সেই নিয়েই লেখা "এমন কেন সত্যি হয়না আহা"। আপাতত রাধা। দেখি কল্পনার দৌড় কদ্দুর যায়।)

এই সোনার প্রাসাদ-চূড়া থেকে আকাশটা অনেক কাছে এসে যাওয়ার কথা, কিন্তু মনে হয় যেন আরো অনেক দূর। কালিন্দীর তীরের সেই নিচু সবুজ ভূমি ও যেন কি কৌশলে ছুয়ে ফেলত আকাশ যখন তখন, অথচ এই মহলের পর মহল জোড়া সোনার প্রাসাদ পারেনা তাকে ছুতে। শুধু আশপাশে বিছিয়ে থাকা একচালা-দোচালা আর দু-একটি ধনীর হর্ম্য কে ছাপিয়ে যাওয়ার অহংকারেই তার সর্বাঙ্গে ফুটে বেরয় রাজরক্তের দ্যুতি। সেই সোনার ছিটে লেগে এখানকার আকাশটাও কেমন অন্য-রঙ্গা--কেমন যেন মেকি লাগে আমার।
ঠিক যেমন মেকি দেখাল দ্রুতচ্ছন্দে প্রাসাদ-শীর্ষে উঠে আসা ওই কিশোর কে, যার একূল-ওকূল আধার করা কালিন্দীর মত কালো গায়ে এখন সোনার পাড় দেওয়া পীতাম্বরের দ্যুতি। বাশের বাশিটির বদলে যার হাত এখন কোমরের তীক্ষ্ণধার তরবারির মুঠ এ। যার কপালে এখন ভ্রুকুটি--এক অচেনা বিরক্তির ছায়া পড়ে যার ভীষণ চেনা, ভীষণ প্রিয় মুখ টাও এখন ভারী অন্যরকম--ভারী মেকি। যে মেকি গলায় সে তার "প্রিয়ে " কে সম্বোধন করে বলে চলে কেন আমার দিনদুপুরে এমন করে ছাতে উঠে আসতে নেই, কেন তার সদ্যলব্ধ রাজ্যের প্রজারা যখন তখন তাদের রানী কে দেখে ফেললে রাজার মান-মর্যাদা ধূলিসাত হয়ে যাবে। না, আমি তো আর সেই কলসী-মাথায় গোপ বাড়ির আটপৌরে বউ শ্রীমতি নই, নই কুঞ্জছায়ার নীরবতা ভরিয়ে তোলা অনেক সাধের, অনেক ভালবাসার রাধা-- আমি এখন মথুরা-নগরপতির গোকুল-মহিষী, আমি এখন কেবল এক নারী।
অথচ সেই যেদিন অক্রুরের রথের চাকার নিচে প্রাণ পেতে দিতে চেয়েছিলাম, যেদিন ওই কালো রূপের আদল পেয়ে কালিন্দিতে ডুব দিতে গিয়েছিলাম, যেদিন ওই নওল কিশোরের ফেলে আসা শূন্য অঙ্গন যেন প্রবাস মনে হয়েছিল আমার চোখে, সেদিন তো এই মথুরার প্রাসাদ-শীর্ষ ই আসত ভোরের স্বপ্ন হয়ে, আকাঙ্ক্ষার তীব্রতম কম্পন হয়ে। অপূর্ণ তিয়াষা হয়ে সেদিন চোখের কাজলে কাজলে তার ই নাম; তদ্গত অনুভবে প্রতি অঙ্গে তার ই অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনের মূর্ছনা। কে জানত সে স্বপ্ন যেদিন সকালের প্রখর আলোয় সত্যি হয়ে ভাসিত হবে, সেদিন সেই চিরকৃষ্ণ, চিরসুন্দর কন্ঠে ধ্বনিত হবে না সর্ব-অভিমান-হর "দেহি পদপল্লবমুদারম", শুধু আমার কুঞ্জ-দ্বারে এসে দাড়াবে স্বর্ণ-লাঞ্ছন-ধারী মথুরার রাজ-রথ-- আমার প্রানের মানুষ দুহাত বাড়িয়ে টেনে নেবেন না তার বিরহিনী রাধাকে, শুধু জনারণ্যের সভায় সভাসদ দের উচ্চকিত জয়ধ্বনিতে আমি দেখতে পাব রাজবেশ-মন্ডিত, গর্বিত, স্থিতধী এক রাজা কে, আমার কৃষ্ণ তো সে নয়! আমার কৃষ্ণ তো এমন মহিমান্বিত রাজা নয়, সে যে পথের রাখাল--আমার কৃষ্ণ তো এমন কূটনীতিজ্ঞ স্থিতধী নয়, সে যে বাশরীর সুরে ভেসে চলা এক উদাসী কিশোর, সে যে আমার যমুনা-পথের বাকে থির হয়ে থেমে থাকা ধৈবতের সুর, সে যে আমার অথির বিজুরির অভিসার-রাতে চির-চঞ্চল একমুঠ জোনাকি। তবে আমি যাকে ভালোবেসেছি সে কি শুধু সেই মুহূর্ত মুহূর্ত দিয়ে গেথে চলা মালা-টুকু? সে কি শুধু সেই দু-কূল ভাসানো প্রেম-টুকু? সে কি শুধু সেই আমার ভিতর তিলে তিলে সৃজন করা আপন মনের মাধুরী মেশানো কৃষ্ণ-নাম-টুকু? তাই কি এই নির্বান্ধব মথুরায়, এই যদু-পতি কৃষ্ণের পাশে একাকিনী "স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি, ভারমুক্ত সে এখানে নাই"?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

স্পিতি-যাপন : পর্ব ৪

আমাদের স্পিতি সফরের দশ দিন বেঁধে রাখতে চাই শব্দের নিগড়ে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ পর্ব। দিন ৪: ছিতকুল-...